Saturday, October 25, 2014

বাজারের সীমা

(অমিতাভ গুপ্তের সাথে লেখা দীর্ঘ এক প্রবন্ধের অংশ)

কেউ যদি টাকার বিনিময়ে কর্মক্ষেত্রে শারীরিক বিপদের ঝুঁকি নিতে রাজি থাকেও, তাকে কি সেই অধিকার দেওয়া চলতে পারে? অর্থের বিনিময়ে গর্ভ ভাড়া দেওয়া কি একটা বিপজ্জনক পথের প্রথম ধাপ? কেউ নিজের কিডনি বা চোখের মণি বিক্রি করতে চাইলে তাঁকে সেই অধিকার দেওয়া উচিত হবে? কেউ স্বেচ্ছা-ক্রীতদাস হতে চাইলে, অথবা কেউ বিপুল অর্থের বিনিময়ে নিজের জীবন দিয়ে অন্য কাউকে তাঁর শরীরের কোন অবশ্যপ্রয়োজনীয় অঙ্গ (যেমন, হৃৎপিণ্ড ) প্রতিস্হাপনের অধিকার দিতে চাইলে সেগুলো কি অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হওয়া বিধেয়?

এই এলোমেলো প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে। প্রতিটা প্রশ্নই আসলে বাজারের পরিধি সংক্রান্ত। অর্থাৎ, বাজারের বাধানিষেধহীন বাণিজ্যকে আমরা কতখানি ঢুকতে দেব আমাদের নিতান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে, আমাদের শরীরের পরিসরে, আত্মার পরিসরেও? ব্যক্তিস্বাধীনতার যুক্তিকে কত দূর অবধি টেনে নিয়ে গেলে সেটা শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিস্বাধীনতার পথেই অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে? আবার, বাজারের মুক্ত বিনিময়ের যদি বিরোধিতা করতে চাই, সেটা কোন যুক্তিতে করব?

প্রশ্নগুলো আপাতদৃষ্টিতে অর্থনীতির হলেও, নৈতিক দর্শন, আইনশাস্ত্র, এমনকী রাজনীতিরও বটে  সেই ১৭৭৬ সালে অ্যাডাম স্মিথ সাহেব লিখে গিয়েছেন, আমরা মাংস পাওয়ার জন্য কষাইয়ের সদিচ্ছা বা মহানুভবতার ওপর নির্ভর করি না। সে নিজের স্বার্থেই মাংস বেচে। তাতে তার লাভ। "বাজারের অদৃশ্য হাত"  আমাদের প্রত্যেককে লাভের দিকে চালিত করে। কিন্তু বাজারের যুক্তি কি বাজারের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থাকে?  শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ গ্যারি বেকার, যিনি এ বছর মে মাসে মারা গেলেন, তাঁর মতে উত্তর হল "না"আমাদের ব্যক্তিগত জীবনও বাজারের নিয়মকে অগ্রাহ্য করে চলতে পারে না। বিয়ে থেকে পরিবার পরিকল্ম্পনা  সব সিদ্ধান্তই এই লাভ-ক্ষতির অঙ্কে বাঁধা। বেকারের বাজার-কেন্দ্রিক জীবনদর্শনের ভিত্তি হল মনুষ্যচরিত্র এবং বাজার সম্বন্ধে কতগুলি বিশ্বাস। এক, মানুষ খামখেয়ালি নয়, সে যে কোনও পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য মাথায় রেখে দুই, যে কোনও সিদ্ধান্তে লাভ ও ক্ষতি দুই-ই আছে, তাই সেটা নেওয়া হবে কিনা তার নীট যোগফলের ওপর নির্ভর করে তিন, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যদি স্বেচ্ছায় এবং স্বজ্ঞানে কিছু কেনাবেচা করে, তাহলে তাতে দুপক্ষেরই লাভ আছে, তাই কোনও রকম বাধা দেওয়া অনুচিত

তার মানে কি বিনিময়ের অধিকারের ওপর কোথাও কোন নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন নেই?


অনেক ভাবেই এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সম্ভব। এই লেখায় আমরা মূলধারার অর্থনীতির যুক্তি ব্যবহার করে সেই চেষ্টা করব। যে কোনও বিনিময়ই প্রকৃত প্রস্তাবে সম্পদ বণ্টনের গল্প। কী ভাবে অর্থনৈতিক সম্পদ বণ্টন করা উচিত, তার তিনটে পৃথক মাপকাঠি প্রচলিত। প্রথমটা efficiency বা কুশলতার মাপকাঠি। দ্বিতীয়টা equity বা fairness, মানে ন্যায্য বণ্টনের মাপকাঠি। তৃতীয়টা liberty বা স্বাধীনতার মাপকাঠি। এই লেখায় তিনটি মাপকাঠিরই ব্যবহার থাকবে। ফলে, গোড়ায় এই মাপকাঠি তিনটে সম্বন্ধে কয়েকটা প্রাথমিক কথা বলে রাখা যাক।[1]


কুশলতার মাপকাঠি বলবে, যে সম্পদের শ্রেষ্ঠ ব্যবহার করতে পারবে, যে কোনও অর্থনৈতিক সম্পদ তার হাতে যাওয়াই বিধেয় । যার কাছে সেই পণ্যের মূল্য সর্বাধিক, যে কোনও পণ্য তার পাওয়া উচিত । যে সম্পদের সবচেয়ে কুশলী ব্যবহার করতে পারবে, তার হাতে পৌঁছলেই সেই সম্পদের মূল্য সর্বাধিক হবে। ফলে, তার পক্ষে সেই সম্পদের আদি মালিককে এমন দাম দেওয়া সম্ভব হবে, যেটা সেই মালিকের পক্ষেও লাভজনক, আবার তার নিজের পক্ষেও। সেই দামে দুপক্ষই বিনিময়ে সম্মত হবে।

এই সহজ যুক্তির আড়ালে অবশ্য দুটো কথা চাপা পড়ে আছে। এক, যে মানুষটা এমনিতে গরিব, অন্যদের তুলনায় কোনও পণ্য তার কাছে বেশি মূল্যবান হলেও দাম দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যদের টপকে যাওয়ার আর্থিক ক্ষমতা তার নেই। ফলে, সে সম্পদটিকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে বা তার সবচেয়ে কুশলী ব্যবহার করতে সক্ষম হলেও, দারিদ্রের কারণে সেটা তার আয়ত্তের বাইরে থেকে যাবে আর দুই, ক্রেতা ও বিক্রেতা, উভয় পক্ষের কাছেই যে বিনিময় লাভজনক, কোনও তৃতীয় পক্ষের ওপর তার negative externality বা নেতিবাচক অতিক্রিয়া থাকতে পারে। আমার বাড়ি আমি প্রোমোটারকে বেচে দিলাম কিন্তু নতুন যে বহুতল হল তাতে পাড়ায় অন্যদের জলের সমস্যা হল বা শব্দদূষণ বেড়ে গেল, সেটা হল অতিক্রিয়ার উদাহরণ ফলে, কুশলতার মাপকাঠিতে হিসেব করার সময় এই নেতিবাচক অতিক্রিয়ার কথা মাথায় রাখতে হবে।

ন্যায্য বণ্টন বললে অনেক কিছুই বোঝানো যেতে পারে। যিনি কথাটি ব্যবহার করছেন, কথাটির অর্থ তাঁর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু, সেই সব মানের একটা অন্তর্নিহিত মিল রয়েছে। সেটা এই রকম ব্যক্তি-পরিচয় নির্বিশেষে সমদর্শী হওয়াসেই সমদর্শী আচরণ কোনও একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সব মানুষের প্রতি হতে পারে। ধরা যাক, কোনও দেশে খাদ্যসংকট দেখা দিল। সে সময় সমদর্শী আচরণের অর্থ, যেটুকু খাবার আছে, তার ওপর সবার সমান অধিকার স্বীকার করে নেওয়া। সেটা খাবারের সমবণ্টনের মাধ্যমে হতে পারে, "আগে-এলে-আগে-পাওয়া-যাবে"র ভিত্তিতে বণ্টন হতে পারে, অথবা লটারির মাধ্যমে বণ্টনও হতে পারে। শেষ দুটি ক্ষেত্রে সবাই খাবার পাবেন না ঠিকই, কিন্তু খাবার পাওয়ার বা না পাওয়ার সম্ভাবনা সবার ক্ষেত্রেই সমান হবে। আবার, কোনও একটি নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতেও সমদর্শী হওয়া সম্ভব। কোনও একটি পরিস্থিতিতে আমি থাকলে অন্যদের থেকে কোন আচরণটি প্রত্যাশা করতাম, সে কথা মাথায় রেখে সেই পরিস্থিতিতে থাকা মানুষদের সঙ্গে আচরণ করাও সমদর্শিতাএই ন্যায্য বণ্টনের যুক্তির বিপরীতে সবচেয়ে পরিচিত যুক্তি হল, কিছু জিনিসের ক্ষেত্রে এমন সাম্য প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। যেমন, মেধা বা প্রতিভার অসাম্য কোনও বণ্টনের মাধ্যমেই দূর হওয়ার নয়। আবার, সুখী হতে পারার ক্ষমতাও সবার সমান নয়। কাজেই, সম বণ্টনে কার উপভোগের মাত্রা কী দাঁড়াবে, সে কথাই বা কে বলবে? এ ক্ষেত্রে ন্যায্য বণ্টনের নীতিটিকে আর একটু স্পষ্ট করে নেওয়া ভাল। ফলাফলের সাম্য নয়, কিন্তু ফলাফলে পৌঁছনোর জন্য যে প্রক্রিয়া, সেটা যাতে সমদর্শী হয়, তা নিশ্চিত করাই এই মাপকাঠির মূল কথা।

তৃতীয় মাপকাঠি স্বাধীনতার। এই মাপকাঠি বলবে, আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজে করতে পারার স্বাধীনতাই সবচেয়ে জরুরি। এই দর্শনে সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজের শরীরও সেই সম্পত্তিরই অংশ। সম্মত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের মধ্যে যে কোনও পারস্পরিক চুক্তির স্বাধীনতা এই দর্শনের মূল কথা। সেই স্বাধীনতায় কোনও বাধা পড়ুক, সেটা নিতান্তই অকাম্য। নিজের সম্পদের ওপর রাষ্ট্র বা সমাজ, কারও খবরদারিই এই মাপকাঠিতে অগ্রহণযোগ্য। এই দর্শনের ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, বিভিন্ন মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা আসলে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। ফলে, যত ক্ষণ আমার ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রয়োগ অন্য কারও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব না করছে, তত ক্ষণই সেই স্বাধীনতার প্রয়োগ সম্ভব।

এই লেখায় আমরা অধিকারের প্রশ্নটিকে consequentialist বা পরিণামবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখব। অর্থাৎ, বাজারের গুণাগুণ বিচার করা হবে মানুষের ওপর সেই বাজারের সম্পদ বণ্টনের পদ্ধতির পরিণামের মাপকাঠিতে। সব ক্ষেত্রেই যে এই পরিণাম উপভোগের মাপকাঠিতে মাপা হবে, তা নয়। আয়, দারিদ্র, স্বাস্থ্য, বা প্রত্যাশিত আয়ুর মতো সূচকও পরিণামের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এই পরিণামবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে right-based বা অধিকার-ভিত্তিক মাপকাঠির প্রাথমিক ফারাক রয়েছে। দ্বিতীয় মাপকাঠি বলবে, বাজার মানুষের কিছু প্রাথমিক অধিকার, যেমন অবাধে মেলামেশার অধিকার অথবা শিক্ষার অধিকার বা অন্য কোনও অধিকার, দিচ্ছে কি না, সেটাই মূল কথা। সেই অধিকার প্রয়োগের ফল কী দাঁড়াল, সেটা বিচার্য নয়।[ii] আরও মনে রাখা প্রয়োজন, কোনও বিকল্প বণ্টন ব্যবস্থার কথা না বলে কোনও একটি বাজারকে নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করার  গুণাগুণ বিচার করা যাবে না। যেমন, কিডনির বাজারকে নিষিদ্ধ করতে হলে তার জন্য বিকল্প কোনও ব্যবস্থার কথা বলতে হবে। যেমন, কিডনি দান, অথবা বিনিময়, অথবা যে কোনও রকম কিডনি প্রতিস্থাপনকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। প্রতিটি বিকল্পই আবার বিভিন্ন মানুষের জীবনে বিভিন্ন ভাবে প্রভাব ফেলবে।

প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের স্বেচ্ছা বিনিময়ের অধিকারের পক্ষে অর্থনীতির যে ঘরানা সবচেয়ে সরব, সেই শিকাগো স্কুলের মিলটন ফ্রিডম্যানের  মতে, যদি কোনও বিনিময়ে দুপক্ষই সম্মত হন এবং দুপক্ষের কাছেই সেই বিনিময় সংক্রান্ত পূর্ণ তথ্য থাকে, তবে সেই বিনিময় থেকে দুপক্ষই লাভবান হবেন।[iii] একটু অন্য ভাষায় বললে, মিয়া বিবি রাজি তো ক্যা করেগা কাজি? এই যুক্তির খাদ তার পূর্বশর্তে উভয় পক্ষের কাছেই বিনিময় সংক্রান্ত পূর্ণ তথ্য আছে এবং সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে সমস্ত ভালো মন্দ বিচার করে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা আছে    বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, হয় এক পক্ষের কাছে সম্পূর্ণ তথ্য নেই (হয়তো তাঁদের খবর জানার উপায় নেই, অথবা তাঁদের ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল বোঝানো হয়েছে), আর নয়তো বিনিময়ের সম্পূর্ণ তাত্পর্য বোঝা তাঁদের ক্ষমতার বাইরে। কিডনি বিক্রির ক্ষেত্রেই যেমন বহু মানুষ পরে আফসোস করেছেন, কারণ বিক্রি করার সময় তাঁরা ভাবতে পারেননি, এই সিদ্ধান্তের ফলে ভবিষ্যতে তাঁদের শারীরিক সক্ষমতা কতখানি হ্রাস পাবে। Rational choice বা যুক্তিসঙ্গত চয়নের তত্ত্ব যে ভাবে সবার কাছে সম্পূর্ণ তথ্য থাকাকে এবং সেই তথ্য ব্যবহার করে সঠিক সিদ্ধান্ত  নেওয়ার ক্ষমতাকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়, সেটা বাস্তবানুগ নয়।

আমাদের কারও কাছেই কোনও সিদ্ধান্ত এবং তার তাত্পর্য সংক্রান্ত সম্পূর্ণ তথ্য নেই। সমস্ত প্রাসঙ্গিক তথ্য হাতের কাছে থাকলেও আমরা যে সিদ্ধান্ত নিই, সবসময়  তার সমস্ত পরিণাম আমরা ভালো করে বুঝে যে নিই, তা নয় আমাদের মধ্যেই অনেকগুলো সত্তার নিত্য সংঘাত চলে, এবং এরকম ভাবার কারণ নেই যে সব সময়ে আমরা সব দিক বিবেচনা করে, এই সব সত্তার নানা দাবির মধ্যে সমঝোতা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিই যেমন, আমরা অনেক সময়েই যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই , যাহা পাই তাহা চাই না! গবেষণায় দেখে যাচ্ছে যে তাত্ক্ষণিক সুখ, প্রয়োজন বা আকর্ষণ আর  নিজের দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণের মধ্যে নিরন্তর যে দ্বন্দ্ব, বাস্তব ক্ষেত্রে মানুষ অনেক সময়েই তার সন্তোষজনক নিষ্পত্তি করে উঠতে পারে না, বর্তমানে নেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে পস্তায় ক্রমশ মূলধারার অর্থনীতিচর্চায় মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মনস্তত্ত্বের প্রভাবকে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে   আচরণবাদী অর্থনীতি (behavioural economics) বলে অর্থনীতির একটি ধারাই তৈরী হয়েছে যার মূল বিষয় হল, তত্ত্ব ও তথ্যের মাধ্যমে যুক্তিসঙ্গত চয়নের কাঠামোর বাস্তবমুখী পরিমার্জন করা [iv]

মূলধারার অর্থনীতিতে যুক্তিসঙ্গত চয়নের কাঠামোতে আরেকটা দিক থেকে কিছু পরিবর্তন এসেছে, যার মূলে আছে এই ধারণা যে কোন ব্যক্তি তো আর সমাজ বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন নয় তাই পরিবারের মধ্যে এবং তার বাইরে বৃহত্তর অর্থনৈতিক পরিসরে, এখন ব্যক্তির সিদ্ধান্তকে বিমূর্তভাবে বিশ্লেষণ করা যায়না, তার সামাজিক পরিচয় (identity) সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এর অনেক দিক আছে, যেমন, লিঙ্গ, প্রজন্ম, জাতপাত, বা সামাজিক মর্যাদা, এবং এদের যেকোনো রকমের সমন্বয় এর ফলে সবার সামনে সিদ্ধান্ত নেবার সময়ে সম্ভাব্য বিকল্পগুলো এক থাকেনা  

কিন্তু, তথ্যের অসম্পূর্ণতা, সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়ায় মনস্তত্বের প্রভাব এবং সামাজিক পরিচয়ের ভূমিকা, তিনটি বিষয়ই এত দীর্ঘপরিসর এবং গভীর যে তার যথাযথ আলোচনার জন্য একটি গোটা লেখা বরাদ্দ করাই ভাল। এই লেখায় আমরা ধরে নেব, সবার কাছে সমস্ত তথ্য রয়েছে, সবাই সেই তথ্যের সম্পূর্ণ অর্থোদ্ধারে সমর্থ, এবং সিদ্ধান্ত নেবার সময় সমস্ত রকম পরিণাম নিয়ে যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা করেই নেয়, এবং সামাজিক পরিচয়ের কোন ভূমিকা নেই সোজা কথায় বলতে গেলে,  সবাই প্রাপ্তবয়স্ক, সম্পূর্ণভাবে অবহিত, এবং নিজের ভালোমন্দ নিজেই সবচেয়ে ভালো বোঝে তাই আমাদের আলোচনার পরিসরের মধ্যে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে স্বেচ্ছা বিনিময়ের অধিকারের  হস্তক্ষেপ করার পক্ষে যুক্তি খাড়া করতে গেলে তা তাদের সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়ার মধ্যে পাওয়া যাবেনা, খুঁজতে হবে তার বাইরে সেটা তাদের সম্পর্কের মধ্যে হতে পারে, বা সেটার সাথে বৃহত্তর সমাজের পারস্পরিক অভিঘাতে হতে পারে   

বাজারের সমর্থকরা বলে থাকেন, বাজার কাউকে জোর করে না।  কেউ স্বেচ্ছায় বাজারে যোগ দিতে পারে, আবার কেউ স্বেচ্ছায় সরে থাকতে পারে সেই বাজার থেকে। মানুষ যখন নিজের ভালমন্দ বিবেচনা করে, ব্যয়-লাভের হিসেব কষে নিয়ে তবেই কোনও সিদ্ধান্ত করে, কাজেই ধরে নেওয়া যায়, যিনি বাজারে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত করছেন, তিনি তাতেই ভাল থাকছেন আর যিনি বাজার থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত করছেন, তিনি ভাল থাকছেন বাজার থেকে দূরে তাঁর নিজস্ব কোণে। অর্থাৎ, বাজার আসার আগে সবাই যতটুকু ভাল থাকছিলেন, বাজার আসার পরে কেউ কেউ ততটুকুই ভাল থাকছেন (যাঁরা বাজারে যোগ দিলেন না, তাঁরা), আর কেউ কেউ বাজারে যোগ দিয়ে আগের চেয়ে ভাল থাকছেন। মোটমাট, সবাইকে যোগ করলে সমাজের ভাল থাকার পরিমাণ আগের তুলনায় বাড়ছে, এবং সেটা বাড়ছে প্রত্যেকের ব্যক্তিস্বাধীনতা বজায় রেখেই। utilitarian বা তৃপ্তিযোগবাদীরা বলবেন, এই তো চাই!

তা হলে বাজারের বিরোধীদের মূল যুক্তিগুলো কী?

প্রথমত, যাকে চয়নের স্বাধীনতা বলে মনে হচ্ছে, তা অনেক সময়েই আসলে ঘোরতর বাধ্যবাধকতা। সামাজিক চাপ, অর্থনৈতিক চাপ, শিক্ষার অভাব, বিকল্প পেশার অভাব সব মিলিয়ে মানুষ অনেক কাজ করতে, অনেক ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন   অর্থাৎ, এই ধরনের চয়ন অসম বিনিময় বা শোষণের (exploitation) উদাহরণ   দ্বিতীয়ত,  কিছু ক্ষেত্রে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে স্বেচ্ছা বিনিময় সমাজে অন্যদের ওপর দূষণের মত প্রত্যক্ষভাবে না হলেও, পরোক্ষ প্রভাব ফেলতে পারে যেমন, কিছু ধরনের পেশা আইনি হলে (যেমন, দেহব্যবসা) অন্য ধরনের পেশায় তার প্রভাব পড়তে পারে বা, বৃহত্তর সমাজে তার কিছু অভিঘাত পড়তে পারে (যেমন, মূল্যবোধের অবক্ষয়) যা কাম্য  নয় এই যুক্তিটি  অতিক্রিয়ার (externality) এবং এর অনেক উদাহরণ এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব  তৃতীয়ত, আইন  ব্যবস্থার নানা ত্রুটি থাকায়, যা আপাতদৃষ্টিতে স্বেচ্ছা বিনিময়, তার মধ্যে অনেকসময়েই জোরজবরদস্তি  (coercion) এবং অপব্যবহারের (abuse) সম্ভাবনা থেকে যায় চতুর্থত, যেহেতু আমরা প্রথমেই ধরে নিয়েছি সবাই প্রাপ্তবয়স্ক, সম্পূর্ণ ভাবে অবহিত, এবং নিজের ভাল-মন্দ নিজেই সবচেয়ে ভালো বোঝে, তাই অবাধ বিনিময়ের (যেমন, মাদকদ্রব্যের কেনাবেচা) কিছু পরিচিত “এখন করছ, পরে কিন্তু পস্তাবে” বা “নিজের ভালো মন্দ বোঝনা” গোছের আপত্তি আমাদের আলোচনার পরিধির বাইরে [v] কিন্তু কিছু উদাহরণ অবশ্য আছে (যেমন, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করা) যেখানে সিদ্ধান্তগুলো একই সাথে এমনই অপরিবর্তনীয়  এবং তাত্পর্যপূর্ণ যে একবার ভুল সিদ্ধান্ত নিলে তার জন্যে সারা জীবন ভুগতে হয় বা, জীবন নিয়েই টানাটানি হতে পারে   আমরা এইসব ক্ষেত্রে স্বেচ্ছা বিনিময়ের অধিকার নিয়ন্ত্রণের কথা আলোচনা করব

দ্বিতীয় এবং শেষ কিস্তির লিংক: http://maitreesh.blogspot.com/2015/01/blog-post.html




[1] এই তিনটি মাপকাঠি প্রসঙ্গে আলোচনার জন্য দেখুন অমর্ত্য সেনের Markets and Freedoms: Achievements and Limitations of the Market Mechanism in Promoting Individual Freedoms, Oxford Economic Papers, October 1993
[ii] এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন Amartya Sen, The Moral Standing of Market, Social Philosophy and Policy, Spring 1985
[iii] Milton Friedman, Capitalism and Freedom, University of Chicago Press, 1962
[iv] এই নামটি একটু বিভ্রান্তিকর কারণ একদিক থেকে দেখলে অর্থনীতির সব ধারাই মানুষের আচরণ নিয়ে চর্চা করে এর সূত্র হল এই চিন্তাটি যে যুক্তিসঙ্গত চয়নের তত্ত্বের চশমা পরে নয়, আগে খালি চোখে দেখা যাক মানুষের আচরণ কী
[v] একই যুক্তিতে যে সব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক, এবং বার্ধক্য বা অসুস্থতার কারণে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সক্ষম নন এমন প্রাপ্তবয়স্করা জড়িত, সেগুলিকে আমাদের আলোচনার পরিধির বাইরে রাখছি    

পিকেটির ভ্রুকুটি

এক সময়ের বাম রাজনীতির প্রচলিত একটা স্লোগান ব্যবহার করে বলা যায়, টমাস পিকেটি তাঁর ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি বইটির মাধ্যমে মূলধারার অর্থনীতির সদর দরজায় বাঁ দিক থেকে একটি কামান দেগেছেন । তবে কামানের গোলাটি বিশাল এবং কিঞ্চিত জটিল।  একটি সমীক্ষায় জানা গেছে প্রায় সাতশো পাতার তথ্য ও বিশ্লেষণ-সমৃদ্ধ এই বইটি কিছুদিন বেস্টসেলার লিস্টে থাকলেও, অধিকাংশ সাধারণ পাঠক এর প্রথম পরিচ্ছদের পর আর বেশিদূর এগোননি।

অর্থনীতিচর্চার জগতে কিন্তু ভালো বা মন্দ  যাই লাগুক, বইটাকে অগ্রাহ্য করার কোন উপায় নেই। বইটির নানা বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, একটা বিষয়ে প্রগতিশীল থেকে রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদেরা সবাই একমত। সরকারি নানা সূত্র থেকে আয় কর, জমির দলিল এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার সম্পর্কিত তথ্য একত্র করে, প্রথমে ফ্রান্স তারপর পৃথিবীর নানা দেশে (তার মধ্যে ভারত-ও আছে) আয় এবং সম্পদের বৈষম্যের দীর্ঘমেয়াদি যে তথ্যভাণ্ডার পিকেটি ও তাঁর সহকর্মীরা (যাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ টোনি অ্যাটকিনসন এবং এমানুয়েল সায়েজ আছেন) প্রায় দুই দশক ধরে গড়ে তুলেছেন এবং গবেষকদের ব্যবহারের জন্যে অনায়াসলভ্য করে দিয়েছেন তা যথার্থই এক মহার্ঘ্য সম্পদ। এতাবৎ এই বিষয়ে যা তথ্যভিত্তিক কাজ হয়েছে (যেমন, ষাটের দশকে কুজনেৎস একজন পথিকৃৎ), দেশ ও কালের পরিধির বিস্তার এবং তথ্যসমৃদ্ধির দিক থেকে সে সবকে এই গবেষণা ছাপিয়ে গেছে। 

এই বইটিতে আলোচিত বিষয়কে কে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণ,  ব্যাখ্যা, এবং বিধান।

বইটিতে প্রথমে পরিসংখ্যানের মাধ্যমে অর্থনীতির কতগুলো মূল সূচকের দীর্ঘকালীন বিবর্তনের বর্ণনা (যা আমেরিকা বা ইয়োরোপের ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে) করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে আয় ও সম্পদের বণ্টন, জাতীয় আয়ে পুঁজি এবং শ্রমের আপেক্ষিক ভাগ,  জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার ও সুদের হার।  এখানে পিকেটি ও তাঁর সহগবেষকদের মূল অবদান হল, পরিবার-ভিত্তিক সমীক্ষার বাইরে গিয়ে কর-সংক্রান্ত নথি ব্যবহার করে আয়ের পরিসংখ্যানের বিকল্প তথ্য সংগ্রহ করা। এর দুটো সুবিধে। সমীক্ষার আওতায় অতি-ধনীরা প্রায় কখনই ধরা পড়েননা এবং অনেক দেশেই করব্যবস্থা চালু হয়েছে এই ধরণের সমীক্ষার প্রবর্তনের আগে। যেমন, আমেরিকায় আয় কর চালু হয়েছে ১৯১৩ থেকে, আর এই সমীক্ষা শুরু হয়েছে ১৯৪৭ থেকে।  তারপরে একটি তাত্ত্বিক কাঠামো খাড়া করা হয়েছে, যাতে এই সূচকগুলোর বিবর্তন ও পরস্পরের মধ্যে কার্যকারণের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা যায়। এবং শেষে, বিশ্লেষণে পাওয়া ক্রমবর্ধমান অসাম্যের মোকাবিলা করতে পুঁজির ওপর বিশেষ করের প্রবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে, এবং কর এড়াতে তথ্যপ্রযুক্তির নয়া দুনিয়ায় অতি-সচল পুঁজির এক দেশ থেকে আরেক দেশে পালানোর প্রবণতা আটকাতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা আছে।  

প্রথম অংশের আলোচনায় বইটির মূল বক্তব্য হল বর্তমানে আয় ও ধনের অসাম্যের মাত্রা প্রায় এক শতাব্দীর ঐতিহাসিক পটভূমিকায় দেখলেও, খুবই বেশি, এবং তা গত প্রায় অর্ধশতক ধরে (সত্তরের দশকের গোড়া থেকে শুরু করে আজ) ক্রমাগত বাড়তেই থেকেছে। তার আগে, ঐতিহাসিক কারণে (যেমন, গ্রেট ডিপ্রেশন ও  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) অনেক ধনী সর্বস্বান্ত হওয়ায়, আর সরকারী নীতির কারণে (যেমন, আয় কর ব্যবস্থা  ও আধুনিক কল্যানমূলক রাষ্ট্রের পত্তনের জন্যে) ১৯৩০ এর গোড়া থেকে ১৯৬০-এর শেষ অবধি অ্যামেরিকা এবং ইয়োরোপে অসাম্য কমেছিল ।  ধরা যাক আয় অনুযায়ী কোন দেশের  সবাইকে আমরা সবচেয়ে বেশি থেকে সবচেয়ে কম এই বিন্যাসে সাজাই, এবং হিসেব করি আয়ের ক্রম অনুযায়ী জনসংখ্যার ওপরের দিকের ১০% বা ১% মোট আয়ের কত শতাংশ অর্জন করেছে।  অ্যামেরিকার ক্ষেত্রে ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০%। আর ওই একই ক্রমবিন্যাস ব্যবহার করে আমরা যদি জিজ্ঞেস করি, যে তলার দিকের ৫০% মোট আয়ের কত শতাংশ অর্জন করেছে, উত্তরটা হল, ২০% - অর্থাৎ, মোট আয় যদি একশো টাকা হয়, এবং জনসংখ্যা যদি একশো হয়, তাহলে সবচেয়ে ধনী ১০ জন পাচ্ছেন ৫০ টাকা, আর তলার দিকের ৫০ জন পাচ্ছেন মাত্র ২০ টাকা। সময়ের নিরিখে দেখলে, ১৯০০ সালে অ্যামেরিকায় ওপরের ১০%-এর আয়ের ভাগ ছিল এখনকার থেকে একটু কম, প্রায় ৪৬%, কিন্তু ১৯৪০ থেকে ১৯৭০ এর মধ্যে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ৩৩%, তার পর থেকে বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় ৫০% এ ঠেকেছে।  আর তুলনামূলকভাবে দেখলে, ১৯২০ থেকে ইয়োরোপে আয়ের অসাম্যের গতিমুখ মোটামুটি একই রকম হলেও, সবসময়েই তার মান অনেকটা কম থেকেছে। যেমন বর্তমানে ওপরের ১০%-এর আয়ের ভাগ হল ৩৫%।      

বইটির দ্বিতীয় অবদান হল আয় আর ধনের যে ক্রমবর্ধমান অসাম্যের ছবি এই বইটিতে ফুটে ওঠে (ওপরে যার একটা চিলতে মাত্র উল্লেখ করেছি), তার একটা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা খাড়া করা।  এর মূলে আছে, পুঁজিসঞ্চয়ের ভূমিকা।  ধরা যাক আপনি আয়ের দিক থেকে একজন গড় নাগরিক। তাহলে আপনার আয়ের বৃদ্ধির হার আর গড়পড়তা জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার কাছাকাছি হবে। এবার ধরা যাক আপনার আয়ের সবটাই হল পুঁজি থেকে অর্জিত সুদ। তাহলে, আপনার আয়ের বৃদ্ধির হার আর সুদের হার কাছাকাছি হবে। পিকেটি দেখাচ্ছেন ঐতিহাসিক ভাবে সুদের হার প্রায় অধিকাংশ সময় বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি থেকেছে । এবার যদি আপনি এই আয়ের প্রায় সবটা সঞ্চয় করেন, তাহলে সময়ের সাথে সাথে আপনার আয় গড় নাগরিকের আয়ের থেকে বাড়তেই থাকবে। তথ্যেও দেখা যাচ্ছে, সময়ের সাথে জাতীয় আয়ে পুঁজি-থেকে অর্জিত আয়ের ভাগ বেড়েছে।  পিকেটি মনে করছেন যে ছবিটা এর থেকে ফুটে  উঠছে  তা মেধাতন্ত্রের  নয়, উত্তরাধিকার-ভিত্তিক ধনতন্ত্রের (patrimonial capitalism)।  

এবার আসি বইটির শেষ অংশে যেখানে এই ক্রমবৃদ্ধিমান অসাম্যের প্রতিকারের আলোচনা আছে। উদারপন্থী কেউ ভাবতেই পারেন, এখানে সমস্যাটা কি? কেউ যদি পরিশ্রম করে ধনসঞ্চয় করে এবং সেটা তার সন্তান-সন্ততিকে দিয়ে যাওয়া সাব্যস্ত করে, তাতে কার কি বলার আছে। শিক্ষিত বা সংস্কৃতিবান পরিবেশে বড় হবারও তো অনেক সুবিধে আছে, এবং এমন তো হতেই পারে শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রেও অসাম্য বাড়ছে কিন্তু তাই বলে তো এগুলো সমানভাবে বেঁটে দেবার কথা কেউ বলেনা। সমস্যা হল, আর্থিক অসাম্য থেকে তৈরি হয় ক্ষমতা বা প্রভাবের অসাম্য। আর ক্ষমতার অসাম্য যত বাড়ে, আদর্শ নীতি আর বাস্তবে যে নীতি অবলম্বন করা হয় এবং রূপায়িত করা হয়, তাদের মধ্যে ফারাকও তত বাড়ে। আইনি ও বেআইনি অনেক পথে ধনীদের রাজনৈতিক প্রভাব মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের থেকে অনেক বেশি।  তাই গণতন্ত্রে প্রত্যেক মানুষের একটা করে ভোট থাকলেও, মানুষে মানুষে অনেক ফারাক আছে, সব মানুষ নয়কো সমান।  একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। আমেরিকায় আয়করের সর্বোচ্চ হার হল ৩৫% আর পুঁজির দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের থেকে লাভের (capital gains) ওপর সর্বোচ্চ করের হার হল ১৫% । তাই, আদতে এই কর ব্যবস্থা প্রগতিশীল নয়, তার উল্টো। এই নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের তালিকায় যাঁর নাম ওপরের দিকে, সেই ওয়ারেন বাফেট লিখেছেন যে তাঁর আয়ের ওপর করের যে আনুপাতিক হার তা তাঁর সব কর্মচারীদের থেকে অনেক কম, কারণ তাঁর মোট আয়ের প্রায় সবটাই পুঁজির বিনিয়োগের থেকে। পিকেটির মতে, এই অসাম্য অনিবার্য নয় এবং করনীতির মাধ্যমে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।  ১৯৯২ সালে আমেরিকায় সর্বোচ্চ অর্জনকারী চারশো করদাতার গড়ে আয়ের ২৬% কর দিতে হত।  প্রেসিডেন্ট বুশের করের হার কমানর নীতির ফলে, ২০০৯ সালে এই হার কমে দাঁড়ায় ২০%। যা কমান যায়, তা বাড়ানোয় যায়। ইয়োরোপেও অসাম্যের মাত্রা অ্যামেরিকার থেকে কম হবার খুব সহজ উত্তর হল, করের হারের ফারাক। পিকেটি পুঁজির ওপর যে বিশ্বব্যাপী করের প্রস্তাব দিয়েছেন, তার বাস্তবসম্মতা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে (পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ছবিটা খুব একটা উজ্জ্বল নয়)। কিন্তু সম্পদের ওপর কর বা আর্থিক সঙ্কটের সময় থেকে অতি-সচল পুঁজির লেনদেনের ওপর করের প্রস্তাব এখন অ্যামেরিকার মূলধারার আলোচনাতেও ঢুকে পড়েছে, যা কিছুদিন আগেও ভাবা যেতনা। 

পিকেটির তথ্য-আহরণ এবং তথ্য-বিশ্লেষণ নিয়ে বিতর্কের খুব একটা অবকাশ না থাকলেও, আয় আর ধনের ক্রমবৃদ্ধিমান অসাম্যের ব্যাখ্যা নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। এই সব প্রশ্ন বা সংশয়ের সম্ভাব্যতা নিয়ে বেশ কয়েকটা তিনি নিজেই আলোচনা করেছেন, এবং নিজের তত্ত্ব অভ্রান্ত বা সর্বাঙ্গীণ এমন কোন দাবি তিনি করেন। পিকেটি নিজেই হিসেব করে দেখিয়েছেন যে গত চার দশকে অ্যামেরিকায় আয়ের সার্বিক অসাম্যের বৃদ্ধিতে পুঁজি-লব্ধ আয়ের অবদান এক-তৃতীয়াংশের বেশি নয়, যা তাঁর পুঁজি-কেন্দ্রিক তত্ত্বের সাথে পুরোপুরি খাপ খায়না। এখানে দক্ষ শ্রম থেকে অর্জিত আয়ের ক্রমবৃদ্ধিমান অসাম্যের একটা বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয় - যেমন ম্যানেজার বা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কারদের আয় সাধারণ শ্রমিকদের মজুরির তুলনায় প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে।  

আয় ও ধনের ক্রমবৃদ্ধিমান অসাম্য নিয়ে পিকেটি যে গুরুত্বপূর্ণ নতুন তথ্য ও বিশ্লেষণ পেশ করেছেন, তা থেকে অস্বস্তিকর বেশ কিছু প্রশ্ন মূলধারার অর্থনীতির সুসজ্জিত প্রাঙ্গনে ঢুকে পড়ে। এই প্রথম দেখতে পাচ্ছি মূলধারার অর্থনীতিতে এমনকি রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদদের গবেষণাতেও অসাম্যের প্রসঙ্গটি গুরুত্বের সাথে নেওয়া হচ্ছে, “অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হলে সব ভালো হয়ে যাবে” বলে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছেনা। বামপন্থী অর্থনীতিবিদরা বলতেই পারেন, আমরা তো চিরকালই এসব বলে আসছি। কিন্তু পিকেটির তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ যে পরিচিত কিছু যুক্তিকে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। শুধু তাই নয়, যতদিন না বামপন্থী অর্থনীতিবিদরা ধনতন্ত্রের সমস্যাগুলোর কোন গ্রহণযোগ্য এবং বাস্তবমুখী সমাধানের পথ দেখাতে পারবেন, যা সমাজতন্ত্রের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কহীন কোন অলীক আদর্শের প্রতি আনুগত্য নয়, অর্থনীতিচর্চার এবং বৃহত্তর জগতে তাঁদের সম্ভাব্য প্রভাব সীমাবদ্ধই থেকে যাবে ।     

অর্থনীতির জগতের বাইরের পাঠকের জন্যেও পিকেটির এই বিশালবপু তথ্য-পরিসংখ্যান-বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ গুরুত্বপূর্ন এই বইটি সব মিলিয়ে সুপাঠ্য ।  বহুচর্চিত হলেও বহুপঠিত কি না তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও, বইটির আপাত-জনপ্রিয়তার কারণটা একটু ভেবে দেখা দরকার। সাম্প্রতিক আর্থিক সংকট এবং তাতে ব্যাঙ্ক আর বিনিয়োগ সংস্থাগুলোর ভূমিকা অতি-ধনীদের প্রতি সাধারণ নাগরিকদের মনে এক গভীর বিরূপতা তৈরি করেছে। অ্যামেরিকায় আর্থিক বৈষম্য নিয়ে যে সামাজিক মনোভাব তা অনেকটাই পাল্টে গেছে - “ওপরের ১%” কথাটা এখন খুবই চালু একটা কথা। করদাতাদের অনুদান দিয়ে ব্যাঙ্কের লালবাতি জ্বলা আটকাতে হবে এইরকম “জিতলে ধনতন্ত্র কিন্তু হারলে সমাজতন্ত্র” মানসিকতার ফলে জনমানসে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এর আগে অ্যামেরিকায় করবৃদ্ধি শব্দটি কোন রাজনীতিক ব্যবহার করতে ভয় পেতেন, এখন সেই অবস্থা খানিকটা হলেও পাল্টেছে।  আসলে, অসাম্যের প্রশ্নের সাথে ন্যায়ের প্রশ্নটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। স্থান, কাল ও পরিস্থিতিভেদে ভেদে কতটা অসাম্য সামাজিকভাবে সহনীয় বা বৈধ, অসাম্যের বিরুদ্ধে নীতি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে শেষ বিচারে এর ভূমিকা বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।  

Thomas Piketty, Capital in the Twenty-First Century,  London & Cambridge, MA: Belknap Press of Harvard University Press, 2014.

এই লেখাটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনন্দবাজার পত্রিকার পুস্তক পরিচয় বিভাগে অক্টোবর ২৪, ২০১৪ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে  (http://econ.lse.ac.uk/staff/mghatak/PikettyBookReview.pdf) ।





 

Wednesday, October 8, 2014

অসাম্যের শিকড়

আগের পোস্টের লিংক: http://maitreesh.blogspot.com/2014/09/blog-post_23.html


আমরা অসাম্য বা বঞ্চনা নিয়ে এতক্ষণ যে আলোচনা করলাম, তা প্রধানত নৈতিক (normative) দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। সারা লেখাটায় “উচিত” শব্দটি কতবার ব্যবহার হয়েছে তার থেকেই তা বোঝা যাবে! এখানে প্রশ্নটা ন্যায্য-অন্যায্যের, কি কারণে অসাম্য বা বঞ্চনা বিভিন্ন অর্থব্যবস্থায় সৃষ্টি হয় তা নয়।  সেইরকম অসাম্যের প্রতিকারের ক্ষেত্রেও আমাদের অবস্থানটা  কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল । তার জন্যে রল্‌সের প্রস্তাবিত নিরপেক্ষ একটা দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ব্যাপারটা আমরা দেখলাম।  রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে কি ভাবে এই অসাম্যের প্রতিকারের নীতি বাস্তবে অবলম্বন করা হয়, সে ব্যাপারে আমরা কিছু বলিনি।  কেউ বলতেই পারেন, ধরে নেওয়া হচ্ছে অজ্ঞানতার কুয়াশা সরে বাস্তবের রোদ উঠলে অজ্ঞানতার অন্ধকারে যে নীতি নির্বাচিত হবে, তা নিখুঁতভাবে রূপায়িত হবে। কিন্তু তার জন্যে যে প্রতিষ্ঠান (institutions) গুলো দায়ি, তারা তো রল্‌সের এই কাল্পনিক পরিকল্পনা কমিশনের মত লোভ-ভ্রষ্টাচার-পক্ষপাত-অন্যায়ের উর্ধে নয়।  বাজারই হোক বা প্রশাসন, সরকারই হোক বা  আইনব্যবস্থা, ক্ষমতাশালীদের প্রভাব থেকে কেউ মুক্ত নয়।  একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই । আমেরিকায় আয়করের সর্বোচ্চ হার হল ৩৫% আর পুঁজির বিনিয়োগের থেকে আয়ের  (capital earnings) ওপর সর্বোচ্চ করের হার হল ১৫% । তাই, আদতে এই কর ব্যবস্থা প্রগতিশীল নয়, তার উল্টো। এই নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের একজন, ওয়ারেন বাফেট লিখেছেন যে তাঁর মত আয়ের ওপর করের যে আনুপাতিক হার তা তাঁর সব কর্মচারীদের থেকে অনেক কম, কারণ তাঁর মোট আয়ের প্রায় সবটাই পুঁজির বিনিয়োগের থেকে। এর কারণ খুব সোজা। আইনি ও বেআইনি অনেক পথে ধনীদের রাজনৈতিক প্রভাব মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের থেকে অনেক বেশি।  তাই গণতন্ত্রে প্রত্যেক মানুষের একটা করে ভোট থাকলেও, মানুষে মানুষে অনেক ফারাক আছে, সব মানুষ নয়কো সমান। 



এই সমস্যাটা শুধু রল্‌সের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। মার্ক্স তাঁর আদর্শ সমাজের বর্ণনা করেছিলেন এমন এক ব্যবস্থা যেখানে প্রত্যেকে তার ক্ষমতা অনুযায়ী দেবে, আর প্রয়োজন অনুযায়ী নেবে। এখানেও, এটা একটা নৈতিক বা আদর্শ অবস্থান। পরিবারের মধ্যে এইরকম একটা নীতির কথা ভাবাই যেতে পারে। গোটা সমাজ নিয়ে এই ভাবে ভাবা যেতে পারে কি না, সেটা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু সে কথা বাদ দিয়েও, সমাজতন্ত্রের যে চেহারা পূর্ব ইয়োরোপ বা চিনে আমরা দেখেছি, তার সাথে এই আদর্শের মিল খুব অল্প। সেখানেও, বাস্তবে নীতির যাদের হাতে রূপায়িত হত, তারা ক্ষমতা হাতে পেয়ে এই আদর্শের থেকে অনেক দূরে সরে গেছিল, ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাহীনদের মধ্যে নতুন শ্রেণী বিভাজনের পত্তন হয়েছিল।  
তার মানে কি এই আদর্শ নীতির আলোচনার কোন মূল্য নেই?  আছে এই কারণে, যে এগুলো আমাদের একটা মানদণ্ড দেয় যা দিয়ে আমরা বাস্তবের হাজারো সমস্যাদীর্ণ বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে যা হতে দেখি তার মূল্যায়ন করতে পারি, বিভিন্ন প্রস্তাবিত নীতির মধ্যে তুলনামূলক বিচার করতে পারি। বাস্তব পৃথিবীর এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দিয়ে চলার পথে যেমন মানচিত্রের প্রয়োজন হয় যেখানে পথঘাট সোজা, সরল, এবং নিখুঁত, বা অসুস্থ রোগীকে সারিয়ে তুলতে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের শরীরের ক্রিয়াপ্রক্রিয়া বোঝার দরকার হয়, এক্ষেত্রে আদর্শ নীতি আলোচনার প্রয়োজনও অনেকটা একই রকম।  আদর্শ পরিস্থিতির মধ্যে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে অসাম্যের দিকে দেখলে তার কতটা অধরা, কতটা অসহনীয়, আর কতটা অনিবার্য না বুঝতে পারলে তার সম্ভাব্য প্রতিকারের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে কি করে?  
একটা কথা বলে শেষ করি। অসাম্যের ভাল-মন্দ বিচারে আমরা দেখেছি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমস্যাটা অসাম্য নয়, বঞ্চনা বা দারিদ্র নিয়ে। কিন্তু বাস্তব পৃথিবীতে অসাম্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ আছে। আর্থিক অসাম্য থেকে তৈরি হয় ক্ষমতা বা প্রভাবের অসাম্য। আর ক্ষমতার অসাম্য যত বাড়ে, আদর্শ নীতি আর বাস্তবে যে নীতি অবলম্বন করা হয় এবং রূপায়িত করা হয়, তাদের মধ্যে ফারাকও তত বাড়ে। এই ক্ষেত্রে সমস্যাটা শুধু দারিদ্র বা বঞ্চনার নয়, অসাম্যেরও।

তবে ধনতন্ত্রে ক্ষমতা আর আর্থিক স্বচ্ছলতার মধ্যে যেরকম সম্পর্ক, অন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থের জায়গায় সেটা অন্যকিছুর অধিকার বা মালিকানা হয়।  যেমন, সামন্ততন্ত্রে জমির মালিকানা এবং বংশানুক্রমিকভাবে প্রাপ্ত মর্যাদা ও বিশেষাধিকার হল ক্ষমতার উৎসতাই আয় ও সম্পদের অসাম্য নিয়ে দুশ্চিন্তা করার জোরদার কারণ একটা আছে। টমাস পিকেটির সাম্প্রতিক বইয়ে আয় ও ধনের ক্রমবৃদ্ধিমান অসাম্য নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নতুন তথ্য এবং অস্বস্তিকর কিছু প্রশ্ন আছে। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন হল, প্রতিকারের উপায় কি - করের হার বৃদ্ধি না কি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গুলোর সংস্কার যাতে সরকারি নীতির ওপর ধনীদের প্রভাব হ্রাস পায়, না কি দুটোই ? না কি এই সমস্যাগুলোর প্রতিকার নেই, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার এগুলো অবশ্যম্ভাবী উপসর্গ ?  এই সব প্রশ্ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এই প্রবন্ধের পরিধির বাইরে।  কিন্তু তাদের গুরুত্ত্ব অস্বীকার করা যায়নাআমাদের প্রতিদিনের জীবনে, অর্থনীতি বা রাজনীতি সব ক্ষেত্রেই ক্ষমতার অসাম্যের বিষময় ফলের উদাহরণ আমাদের চারপাশে। খুব আদিম নানা সংঘাত আমাদের চারপাশে অহরহ ঘটে চলে, যা মূলত জোরজবরদস্তি করে দরিদ্রের নামমাত্র  সম্বল (তা জমিই হোক, বা প্রাকৃতিক সম্পদ) কবজা করার জন্যে ধনীর অক্লান্ত প্রয়াস। আইন আছে, রাষ্ট্রব্যবস্থা আছে,  রাজনৈতিক দল আছে,   কিন্তু এই সব ক্রীড়াঙ্গনও তো সমতল নয় – এখানেও সুযোগের অসাম্য প্রবল।

ক্ষমতার অসাম্যের সাথে আয় বা সম্পদের অসাম্যের সম্পর্ক, এবং তার কার্যকারণ ও সম্ভাব্য প্রতিকার বোঝা অবশ্য প্রয়োজনীয়। তা নিয়ে পরে কখনো বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছে রইল। কিন্তু প্রথমে বোঝা দরকার, আদর্শ ব্যবস্থা আমাদের আয়ত্তে থাকলে আমরা কি চাইতাম। অর্থাৎ, ফিরে যেতে হবে জন্মের আগের সেই কুয়াশাঘেরা প্ল্যাটফর্মে 

নুষ্টুপ, শারদীয় সংখ্যা, ২০১৪ এ প্রকাশিত । সম্পূর্ণ লেখাটির লিঙ্ক : http://econ.lse.ac.uk/staff/mghatak/anushtup2014.pdf 

 

Tuesday, September 23, 2014

সমস্যাটা অসাম্য না বঞ্চনা?


আগের পোস্টের লিংক: http://maitreesh.blogspot.com/2014/09/blog-post_9.html

সুকান্ত যে ধনীদের প্রতি তাঁর তীব্র শ্লেষ নিক্ষেপ করেছেন তার পটভূমি মনে রাখা দরকার। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি লেখা এই ছড়ার ঠিক আগে তেতাল্লিশের মন্বন্তরে বাংলায় বহুলক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যান এবং তা রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ঔপনিবেশিক ও আঞ্চলিক সরকারের বড় দায়িত্ব ছিল, কিন্ত তা ছাড়াও, স্বদেশী কালোবাজারি ব্যবসায়ী, ধনী কৃষক, এবং জমিদারদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকাও ছিল। এই জায়গা থেকে দেখলে বোঝা যায় কেন সুকান্ত লিখেছেন,বড়লোকের ঢাক তৈরি গরীব লোকের চামড়ায়”

 

ইতিহাসের বিশেষ কোন পর্যায়ে এটাই রীতি হতেই পারেদাস ব্যবস্থার কথা নয় বাদই দিলাম, যার অন্যায্যতা নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনা। উনবিংশ শতাব্দীর অ্যামেরিকায়, রবার ব্যারন কথাটা ব্যবহার হত সেই সব ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি সম্পর্কে যাঁরা অন্যায় উপায়ে ধন সঞ্চয় করতেন । তার মধ্যে সরকারকে উৎকোচ দিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, শ্রমিকদের শোষণ করা, অন্যায় উপায়ে প্রতিযোগিতার পথ বন্ধ করা, শেয়ারের দাম ইচ্ছে করে বাড়িয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সেই কোম্পানি ইচ্ছে করে লাটে তুলে দেওয়া ছিল (শেষোক্ত প্রসঙ্গে পরশুরামের “শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী প্রাইভেট লিমিটেড” গল্পটি স্মরণীয়)। মার্ক্সের আদিম ধনসঞ্চয়ের (primitive accumulation) তত্ত্ব এখানে মনে পড়ে যেতে বাধ্য

 

সমসাময়িক ভারতের অর্থনীতিতে এই ধরণের ডাকাত ধনপতি নেই বললে নেহাতই বাস্তবকে অস্বীকার করা হয়। কিন্তু সব সমাজে সব ধনী যে সব সময়ে অসৎপথেই তাঁদের সব টাকা রোজগার করেন, তাও তো বলা যায়না।  অনেক সময়েই তাঁরা নতুন কিছু উদ্ভাবন করে  কিম্বা কোন পণ্য বা পরিষেবা উৎপাদন ও যোগানের মাধ্যমে সৎপথেই লাভ অর্জন করেন।  শুধু তাই নয়, এঁদের বিনিয়োগের ফলে চাকরির চাহিদা বাড়ে, এবং মজুরি ও কর্মনিয়োগের মাধ্যমে দারিদ্র কমে।  এঁদের আয়ের থেকে যে কর সংগৃহীত হয় তার ফলে সরকারি পরিকাঠামো এবং পরিষেবার ওপর খরচ করার সামর্থ্য বাড়ে। সেই জন্যেই দেশে-বিদেশে বাম থেকে ডান সব সরকারই বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রচেষ্টায় সদাব্যস্ত। অর্থাৎ, ধনতন্ত্রে সব খেলা তো আর শূন্য অঙ্কের খেলা নয়, কিছু কিছু খেলা ধনাত্মক অঙ্কেরও হয়। লাভ মানেই শোষণ এই সমীকরণ সবক্ষেত্রে নিশ্চয়ই খাটেনা। আর একটা কথা আছে। যেখানে অসাম্যের সূত্র অন্যায্য উপায়ে আহৃত সম্পদ, সেখানে আমাদের মূল সমস্যা অসাম্য নিয়ে, না যে অন্যায় ব্যবস্থার ফলে সেটা হয় সেটা নিয়ে? এই ক্ষেত্রে অসাম্য হল উপসর্গমাত্র, অসমান খেলার মাঠ এবং অন্যায় খেলার নিয়ম হল মূল সমস্যা।  সেই ব্যবস্থার সংস্কার না করে ধনের পুনর্বণ্টন করলেই যে সমস্যা মেটেনা, নতুন ডাকাত ধনপতিদের জন্ম হয় মাত্র, এর উদাহারণও ইতিহাসে প্রচুর 

দ্বিতীয়ত, এমন যদি হয় যে ধনীরা তাদের বিত্ত পরিশ্রম ও সঞ্চয়ের মাধ্যমে সৎপথেই অর্জন করেছেন, তাহলে সরকারের ন্যূনতম  ভূমিকা পালন করার যে খরচ, তার অংশ দেওয়া ছাড়া  কি আয় বা সম্পদের পুনর্বণ্টনের স্বপক্ষে কোন যুক্তি আছে? আছে, কারণ আর সব কিছু এক রেখে আর্থিক দিক থেকে কেউ যদি অভাবী হয়, সে তার মেধার বিকাশের সুযোগ কম পাবে, তার ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা ও দক্ষতার সাথে ফলাফলের সমীকরণে একটা ঘাটতি পড়ে যাবে। এখানে মেধাতন্ত্রের যুক্তিটা খাটেনা । সবচেয়ে ভালো দল বা খেলোয়াড় জিতুক খুব ভালো কথা, কিন্তু খেলার মাঠ তো সমান নয়।  মতি নন্দীর কোনি পাঠকের অকুণ্ঠ সমর্থন পায় কারণ তার সাথে তার স্বচ্ছল প্রতিদ্বন্দীদের সুযোগ এবং সম্পদের বিশাল ফারাক। আমরা ক্ষিদ্দার সাথে মনে মনে বলে উঠি “ফাইট, কোনি, ফাইট” কারণ এমন নয় যে কোনির প্রতিভা সবার থেকে অনেকটা বেশি। কারণ হল, তাকে অন্যান্য প্রতিযোগীদের তুলনায় অনেক বেশি বাধা অতিক্রম করতে হচ্ছেসেই বাধা দারিদ্রের, এবং তজ্জনিত সুযোগের অভাবেরএই ক্ষেত্রে খেলাটা হয়তো গট-আপ নয়, কিন্তু প্রতিযোগীদের মধ্যে ফারাকটা শুধু  দক্ষতা আর পরিশ্রমের নয়, সুযোগেরওঅর্থাৎ অন্যায় না হলেও এটা অসমান প্রতিযোগিতা।   আরেকটা উদাহরণ নেওয়া যাক - শিশু শ্রম। শিশু শ্রমিক হল সুযোগের অসাম্যের একটা চরম নিদর্শন । অভাবের কারণে যার পড়াশুনো হলনা, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় প্রথম ধাপেই সে অনেকটা পিছিয়ে পড়ল । তার মানবসম্পদ বিকশিত না হয়ে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল। তাতে তারও ক্ষতি, সমাজেরও ক্ষতি অথচ এই ক্ষেত্রে তার প্রত্যক্ষ কোন দায়িত্ব নেই দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়াটা এই দিক থেকে দেখলে নিতান্তই জীবনযুদ্ধের প্রাঙ্গনে ঢাল-তরোয়াল-বর্ম-রথ ছাড়া সশস্ত্র সেনানীর মুখোমুখি হবার মত। 

আমাদের মূল বিষয়ে যদি ফিরে আসি, এই প্রতিবন্ধক আর্থিক হবার জন্যে আমরা যে পদ্ধতির (অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠন) মাধ্যমে পুনর্বণ্টনের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলোর বিচার করছি, এই ক্ষেত্রে পক্ষের যুক্তিটা বেশ জোরদার । সমান দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও, এবং সমান পরিশ্রম করেও কেউ যদি আর্থিক কারণে সমান সুযোগ না পায়, আর তার জন্যে সে যদি ফলাফলের দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে, তাহলে সেটাকে আর যাই হোক মেধাতন্ত্র বলা যায়না। উদ্যম ও প্রচেষ্টার প্রণোদক হিসেবে এবং মেধাতন্ত্রের যুক্তিতে ফলাফলের অসাম্য যদি আমরা মেনেও নিই,  অন্তত আর্থিক সুযোগের অসাম্য দূর করার জন্যে নীতির বিপক্ষে নৈতিক দিক থেকে খুব একটা যুক্তি নেই। আপনার মনে হতেই পারে, ঠিক আছে, পৃথিবীতে অনেক অন্যায় আছে, কিন্তু আমার হাতে তো নাই ভুবনের ভার। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আপনি অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠনের আড়ালে এই নীতির আলোচনা করছেন, ভাগ্যচক্রে সুযোগের অভাবের শিকার আপনিও হতে পারেন।  খেয়াল করে দেখুন, এখানে যারা সুযোগের দিক থেকে পিছিয়ে আছে তাদের সমান সুযোগ দেবার কথা হচ্ছে, যাতে তারা সমতল ক্রীড়াঙ্গনে (level playing field) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে । সেটা করতে গেলে নিশ্চয়ই অর্থের প্রয়োজন, এবং সেই অর্থ নিশ্চয়ই বিত্তবান শ্রেণীর কাছ থেকেই আনুপাতিক হারে বেশি আসবে কারণ তাদের সামর্থ্য বেশি। এখানে লক্ষ করার বিষয় হল, এই যুক্তি অনুসারে সমস্যাটা কিন্তু দারিদ্রের, অসাম্যের নয়। যদিও বাস্তবে দারিদ্র ও অসাম্য অনেক সময়ে একইসাথে দেখা যায়, যুক্তির দিক থেকে দেখলে তাদের মধ্যে কোন সরল সম্পর্ক নেই। দরিদ্র এমন সমাজের কথা ভাবাই যায় যেখানে অসাম্য (অর্থাৎ ধনী-দরিদ্রের ফারাক) কম, আবার অসম সমাজের কথা ভাবা যায়, যেখানে দারিদ্র কম।  দারিদ্রের কারণে সুযোগের যে অসাম্য, এখানে সেটা দূর করাই উদ্দেশ্য, ফলাফলের অসাম্যের বিরুদ্ধে কিন্তু কোন নীতি নেওয়া হচ্ছেনা।

এই প্রসঙ্গে সামাজিক বৈষম্যের কথা উল্লেখ না করলে আলোচনা নেহাতই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।  সুকান্ত তাঁর ছড়াটিতে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের ওপরেই মনোনিয়োগ করেছেন, যা প্রথাগত বামপন্থী চিন্তাধারাতেও সচরাচর করা হয়ে থাকে। আর্থিক অবস্থা এক রেখেও, সামাজিক বিধির কারণে বর্ণ-জাতি-লিঙ্গ ভেদে সবাই সমান সুযোগ পায়না। প্রতিদিন নানা ভাবে যদি কেউ তাঁর সামাজিক অবস্থান বা লিঙ্গের কারণে নানা বাধার মুখোমুখি হন, মেধাতন্ত্রের স্বপক্ষে যুক্তিটা দুর্বল হয়ে পড়ে।  আগের অংশে আলোচনা করেছি যে মেধাতন্ত্রের একটা প্রাথমিক শর্ত হল, সমান  কাজের জন্যে সমান আয়।  সামাজিক বৈষম্যের ফলে এই শর্ত লঙ্ঘন হয়। শুধু তাই না, এই বৈষম্যের প্রত্যাশা প্রতিভার বিকাশের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। মহাভারতের একলব্যের কথা আজও আমাদের পীড়া দেয় । আর  “মেয়েদের কাজ সংসার করা” বা “মেয়েরা বিজ্ঞানে কাঁচা” এই ধরণের বাক্যে যুগে যুগে অজস্র প্রতিভা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়েছে।  এই ধরণের বৈষম্যের প্রতিকারের নানা নীতির মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আইনি ব্যবস্থা, সামাজিক-অবস্থান ভিত্তিক বিশেষ আর্থিক সাহায্য (যেমন, মেয়েদের জন্যে বিশেষ বৃত্তি), এবং সংরক্ষণ পড়ে, যদিও এদের নির্দিষ্ট রূপ এবং আপেক্ষিক গুণাগুণ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, যা এই আলোচনার পরিধির বাইরে। খেয়াল করে দেখুন যে এই ক্ষেত্রেও রল্‌সের যুক্তিটা প্রযোজ্য – আপনার সামাজিক পরিচিতি কি হবে আপনি যদি না জানেন, তাহলে নিশ্চয়ই আপনি বৈষম্য-বিরোধী নীতি সমর্থন করবেন।     

তৃতীয়ত, এবার আসি আরেক স্তরের জটিলতায়ধরা যাক ধনীদের সম্পদ অন্যায় উপায়ে আহৃত নয় এবং যে ধরণের সুযোগের অসাম্য কথা এক্ষুনি আলোচনা করলাম, তা প্রযোজ্য নয়। ধরা যাক একই পরিবারের মধ্যে দুই ভাই বা দুই বোনের কথা। ধরে নেওয়া যাক ছোটবেলা থেকেই তাদের মধ্যে বাহ্যিক সুযোগের কোন ফারাক নেই। তাহলেও অনেক সময়ই দেখা যাক তারা জীবনে সমানভাবে সফল হয়না (সে সাফল্যের যে মানদণ্ডই আমরা নিই, অর্থ বা যশ বা সুখ )এর জন্যে হয় দক্ষতা ও ব্যক্তিগত গুণাবলীর, বা পরিশ্রম ও উদ্যমের ফারাক, বা নেহাতই ভাগ্যের ভূমিকা থাকে। এবার প্রশ্ন হল, এই ক্ষেত্রে যে তুলনায় অসফল, তার প্রয়োজনে তাকে সাহায্য করার জন্যে তার পরিবারের বাড়তি কিছু করণীয়? পরিবারের ক্ষেত্রে উত্তরটা সচরাচর হ্যাঁ, কারণ স্নেহ-মমতার স্বাভাবিক ধর্মেই সেখানে প্রয়োজন এবং সাহায্যের মধ্যে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক আছে। এবার ধরে নেওয়া যাক যে সমাজেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধনী এবং গরীবের অসাম্যের সূত্র সুযোগের অসাম্য নয়, যোগ্যতার ফারাকের, জীবনের নানা পদক্ষেপে নেওয়া কিছু ভুল সিদ্ধান্তের ফলের (যেমন, কুসঙ্গে মিশে পড়াশুনো ছেড়ে দেওয়া, বা নেশার বশ হওয়া), বা নেহাতই দুর্ভাগ্যের (যেমন, দুর্ঘটনা বা মন্দার কারণে চাকরি হারানো) প্রতিফলন  এখানে কি যে পিছিয়ে পড়েছে তার প্রতি সমাজের কোন দায়িত্ব আছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার? রল্‌সের প্রস্তাবিত আঙ্গিকে ভাবলে এক্ষেত্রে যে বঞ্চিত তার জীবনযাত্রার মান যেন ন্যূনতম একটা স্তরের তলায় না চলে যায়, তার ব্যবস্থা করা উচিত তার কারণ হল এই প্রস্তাবিত নীতি একটা বীমার প্রকল্পের মত, যা একটু আগে আলোচনা করেছি। বীমার প্রকল্পের ধর্মই হল, শুরুতে সবাই একই পরিস্থিতিতে থাকে, এবং সমান হারে কিস্তি দেয়, কিন্তু তারপর যার প্রয়োজন (অসুখ বা দুর্ঘটনার কারণে) সে সেই অনুযায়ী সাহায্যলাভ করে। লক্ষ্য করে দেখুন যে এই যুক্তির সাথে সুযোগের সাম্য তৈরি করার কোন সম্পর্ক নেই । আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের স্বপক্ষে এই “সামাজিক বীমার” যুক্তিটি অনেক সময় ব্যবহার করা হয়

প্রবন্ধের প্রথম অংশের তুলনায় এখানে অসাম্যের উদাহরণ গুলো এমন, যে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই পুনর্বণ্টনের সমর্থনে যুক্তি আছে। যদি অসাম্যের উৎস হয় অন্যায় শোষণ তাহলে পুনর্বণ্টনের পক্ষে যুক্তি হল ন্যায়ের যুক্তি। ফলাফলের অসাম্যের উৎস যদি হয় আর্থিক সুযোগের অসাম্য, বা প্রত্যক্ষ সামাজিক বৈষম্য তাহলে পুনর্বণ্টনের স্বপক্ষে যুক্তি হল, সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করার। মনে রাখা ভালো, আগের অংশে আমরা এমন কিছু উদাহরণ দেখেছি, যাতে সুযোগের অসাম্য থাকলেও (যেমন মা-বাবার শিক্ষা বা ব্যক্তিগত গুণাবলী) তার প্রতিকারের জন্যে কোন নির্দিষ্ট নীতির কথা ভাবা মুশকিল আর অসাম্যের উৎস যদি সুযোগ-সম্পর্কিত নাও হয় (যেমন, ভুল সিদ্ধান্ত, দুর্ভাগ্য) তাহলেও সবার জীবনযাত্রার মান যেন ন্যূনতম একটা স্তরের নিচে না চলে যায়, পুনর্বণ্টনের স্বপক্ষে এই ধরণের সামাজিক বীমার একটা যুক্তি আছে।  

এখন অবধি আমরা অসাম্যের পক্ষের এবং বিপক্ষের যুক্তিগুলো আলোচনা করলাম। কিন্তু এগুলো যোগ-বিয়োগ করে কি সিদ্ধান্তে আসব?

মূল লড়াইটার একদিকে সুযোগের অসাম্য এবং ভাগ্য-তাড়িত চরম অনটনের প্রতিকার আর অন্যদিকে অর্থনৈতিক দক্ষতাহ্রাসের সম্ভাবনা। আমরা যেহেতু রল্‌সের পদ্ধতি ব্যবহার করছি, অসাম্যের পক্ষে অন্য যে যুক্তি, মেধাতন্ত্র এবং ব্যক্তিস্বাধীনতায় অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ, সেখানে অতটা জোর দিচ্ছিনা। কারণ, যে নীতি অবলম্বন করা হবে, তা আমরা আমাদের ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে সরে গিয়ে একটা নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে করছি। তাই মেধাতন্ত্রের কথা মাথায় রেখেই আমরা সুযোগের অসাম্যের প্রতিকার করছি। আর, যেহেতু এই নীতি নির্ধারিত হচ্ছে স্বেচ্ছায়, আমাদের এই নিরপেক্ষ সত্ত্বার দিক থেকে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হচ্ছেনা। সেই রকম, অসাম্যের বিপক্ষে যে যুক্তি এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে তাতে অন্যায় শোষণের সম্ভাবনা থাকবেনা, কারণ আমরা স্বেচ্ছায় নিরপেক্ষ ভাবে এরকম ব্যবস্থার কখনই সমর্থন করবনা, কারণ অজ্ঞানতার কুয়াশা সরে বাস্তবের রোদ উঠলে আমরা নিজেরাই শোষিতের দলে পড়ে যেতে পারি।  

সুযোগের অসাম্য এবং ভাগ্য-তাড়িত চরম অনটনের প্রতিকার আর অর্থনৈতিক দক্ষতাহ্রাসের যে দ্বন্দ্ব তা আমরা কিভাবে নিষ্পত্তি করব? উত্তরটা কি মাঝামাঝি রফা? অর্থাৎ, বেশি অসাম্য ভালোনা, আবার বেশি সাম্যও ভালোনা - যাকে বাংলাভাষায় “মিউচুয়াল” করে নেওয়া বলা হয়তা করব্যবস্থার মাধ্যমে না হয় আয়ের অসাম্য খানিক কমানো গেল, অতি-উদারবাদীরা ন্যূনতম প্রশাসনের খরচ মেটাতে যতটাতে খুশি হবেন, সুযোগের সাম্য এবং সামাজিক সুরক্ষাজালের কথা ভেবে তার থেকে নয় বেশিই পুনর্বণ্টন করা হবে ঠিক হল। কিন্তু প্রশ্নটা হল প্রয়োজনের কোন মাপকাঠি ব্যবহার করে পুনর্বণ্টনের প্রস্তাব রূপায়িত হবে ?

রল্‌সের মত হল, দুজন মানুষের মধ্যে সুযোগের তুলনা করার প্রধান মাপকাঠি হল, কিছু সর্বপ্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর তাদের অধিকার। আমাদের নানা জনের নানারকমের পছন্দ   এবং বয়সের সাথে সাথে সেগুলো পাল্টাতেও থাকে। হয়ত আমরা কেউ অর্থ, কেউ যশ, কেউ সুখ চাইব। তাই আদি অবস্থানের কুয়াশাময় প্লাটফর্মে বসে জীবনে কি চাই, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুশকিল। ভুতের রাজা যদি বর দিতে চান, তাহলে খুব নির্দিষ্ট কিছু চাইলে মুশকিল, পরে আক্ষেপ হতে পারে। রল্‌স্ এখানেও একটা ভালো বুদ্ধি বার করেছেন, সেটা হল প্রাথমিক পণ্যের (primary goods) ধারণা ।  আমরা জীবনে কি করব না জানলেও, প্রতি পদে যা চাইতে পারি তা পাবার সর্বোচ্চ সম্ভাবনা যা যা থাকলে হবে, তাই হল প্রাথমিক পণ্য। অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠনের আড়ালে বসে আমরা সবাই তাই একমত হতে পারি,  প্রাথমিক পণ্য আমাদের কতটা আয়ত্তে সেটাই আমাদের জীবনে সুখ এবং সাফল্যের (তার নির্দিষ্ট রূপ যাই হোকনা কেন) সব চেয়ে বড় নির্ধারক।  এর মধ্যে যেমন মৌলিক কিছু অধিকার আছে (যেমন রাজনৈতিক, ধর্মপালন ও মতপ্রকাশের অধিকার), সেরকম সুযোগের দরজা (যেমন, বিভিন্ন পেশায় যোগ দেবার পথ) খোলা থাকার কথা বলা আছে, আয় ও ধনের অধিকারও আছে, এবং আত্মসম্মানের সাথে সমাজে বাস করার অধিকারও আছে। ভুতের রাজার বর সত্যি যারা পেয়েছিল, সেই গুপি আর বাঘা কি চেয়েছিল এই প্রসঙ্গে তার উল্লেখ করতেই হয়।  প্রথম বরে তারা ইচ্ছেমত পছন্দসই খাবার পাবার, দ্বিতীয় বরে যেখানে খুশি নিমেষে যাবার, এবং তৃতীয় বরে, এমন সঙ্গীতপ্রতিভা আয়ত্ত করার বর চেয়েছিল, যাতে তাদের গান শুনে লোকে সম্মোহিত হয়ে যাবে এই তিনটেই প্রাথমিক পণ্যের ভালো উদাহরণ, বিশেষত তিন নম্বর বরটির মধ্যে পছন্দসই পেশা এবং সামাজিক সম্মান দুটোই আছে।        

লক্ষ্য করে দেখুন, প্রাথমিক পণ্যের ধারণার মধ্যেই যে চরম দারিদ্র বা সামাজিক বৈষম্য বা মৌলিক কিছু অধিকারের অভাব যে ন্যায্য সমাজব্যবস্থার ধারণার সাথে খাপ খায়না তা মেনে নেওয়া হচ্ছে। আমরা আগেই দেখেছি নৈতিক আপত্তি না থাকলেও সাহস করে জাত বা লিঙ্গবৈষম্যের প্রস্তাবে কেউই একমত হবেন না – অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠন সরে গেলে যদি দেখতে পাওয়া যায় আপনারই কপালে জুটেছে বঞ্চিত গোষ্ঠীর সদস্যপদ! তাই এই যুক্তি ব্যবহার করে আইনের চোখে সবার সমান অধিকারের প্রশ্নে একমত হওয়া সোজা। 

প্রাথমিক পণ্যের মধ্যে যেগুলো বস্তুগত (আয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি) সেগুলো একটা ন্যূনতম মাত্রায় যাতে সবার আয়ত্ত থাকে, তার জন্যে যে খরচ তা মেটাতে করব্যবস্থার মাধ্যমে আয় ও সম্পদের আংশিক পুনর্বণ্টন প্রয়োজন। এখন এই পণ্যগুলো যোগান দেবার দায়িত্ব সরকার প্রতক্ষ্যভাবে নেবে (সরকারি স্কুল, হাসপাতাল) না তার জন্যে অর্থসাহায্যের ব্যবস্থা করে সেগুলো যোগাড় করে নেবার দায়িত্ব ব্যক্তি বা পরিবারের হাতে ছেড়ে দেবে, সেই প্রসঙ্গে এখানে ঢুকছিনা। 

কিন্তু প্রশ্ন হল, এই পুনর্বণ্টনের জন্যে যে সুযোগের অসাম্যের অথবা চরম অনটনের আংশিক প্রতিকার হবে তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক দক্ষতা খানিকটা হ্রাস পাবে (করের হার বেশি হলে ব্যক্তিগত উদ্যম খানিকটা খর্ব হবেই) এই লাভক্ষতির হিসেব কি করে করা হবে? এর কোন নৈর্বক্তিক উত্তর হয়না, তা আমাদের নৈতিক বিচারের ওপর নির্ভর করবে। রল্‌সের নিজস্ব মত হল, আদর্শ নীতি হল তাই, যা সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মানুষের সর্বোত্তম কল্যাণের কথা ভেবে নেওয়া। এই প্রসঙ্গে গান্ধীর বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে যেতে বাধ্য - “যে কোন পদক্ষেপ নেবার আগে তোমার পরিচিত সবচেয়ে দরিদ্র এবং দুর্বল মানুষের মুখটা ভাব এবং ভেবে দেখ এতে তার কোন উপকার হবে কিনা।” এই বিষয়ে বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন মত থাকতে পারে। কেউ মনে করতে পারেন, যে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা নয়, গড় নাগরিকের কল্যাণের ওপর জোর দেওয়া উচিতবা কেউ এমনও মনে করতেই পারেন, সরকারের ন্যূনতম দায়িত্ব পালনে যে খরচ তার বাইরে কোন রকম পুনর্বণ্টনের প্রয়োজন নেই। যিনি ঝুঁকির পরোয়া করেননা, তিনি জানেন যে তাঁর ভাগ্য ভালোও হতে পারে, আবার মন্দও হতে পারেকিন্তু এই ঝুঁকি নিতে তিনি প্রস্তুত, বিশেষত পুনর্বণ্টনের ফলে যখন অর্থনৈতিক দক্ষতার ক্ষতি হতে পারে।   

এখানে লক্ষণীয় এই যে, রল্‌সের নীতিকে আপাতদৃষ্টিতে খুবই সমতাপন্থী মনে হলেও, এই ক্ষেত্রেও কিন্তু আয়ের ও সম্পদের খানিকটা অসাম্য মেনে নেওয়া হচ্ছে। তার কারণ, আয় বা সম্পদ সর্বদা সম্পূর্ণ সমান হবে এরকম নীতি অবলম্বন করলে, অর্থনৈতিক দক্ষতাহ্রাসের সম্ভাবনা এতটাই হবে, যে তাতে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মানুষেরও কল্যাণ হবেনা।  উদাহরণ হিসেবে ভাবা যেতে পারে বৈষয়িক প্রণোদনের অভাবে উদ্যম যদি তলানিতে গিয়ে ঠেকে, তাহলে দেশের গড় আয় এতটা কমে যাবে, যে কর ব্যবস্থার মাধ্যমে পুনর্বণ্টন করে সবচেয়ে দরিদ্রদের সাহায্য করার সামর্থ্যও কমে যাবে।  তার মানে, খানিকটা অসাম্য অনিবার্য।

এখন অবধি অসাম্যের পক্ষে এবং বিপক্ষে যত যুক্তিই আমরা দেখলাম, তাতে সমস্যাটা আপাতদৃষ্টিতে বঞ্চনা বা দারিদ্রের, অসাম্যের নয়। রল্‌সের প্রস্তাবিত নৈতিক কাঠামোরও মূল উদ্দেশ্য বঞ্চনা বা দারিদ্রের মোকাবিলা করা, এবং তার জন্যে যেটুকু অসাম্য হ্রাস করা প্রয়োজন, ততটাই। এখন ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান কি হওয়া উচিত, তা স্থান ও কালের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু কোন বিশেষ স্থান ও কালে,  রল্‌স্ যে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মানুষের জীবনযাত্রার মান সর্বাধিক সম্ভব মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যর কথা বলছেন, সেখানে জীবনযাত্রার মানের ধারণাটা আপেক্ষিক (relative) নয়, অনাপেক্ষিক (absolute) ভাবা যেতেই পারে। তবে এই নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। কেউ আবার মনে করতেই পারেন যে জীবনযাত্রার মানের ধারণাটাই একধরণের আকাঙ্ক্ষা (aspiration) থেকে তৈরি হয় এবং তাতে সমাজে স্বচ্ছল মানুষের জীবনযাত্রার মানের একটা প্রভাব থাকে। এইভাবে ভাবলে  দারিদ্র বা বঞ্চনার একটা আপেক্ষিক দিক আছে, এবং এই ক্ষেত্রে অসাম্য নিয়েও ভাবতে হবে, কারণ সমাজ যত অসম হবে, তাতে এই আপেক্ষিক চাওয়া বাড়বে, এবং তার অভাবে জীবনযাত্রার মান বাড়াবার এক ইঁদুর দৌড়ে সবাই সামিল হয়ে যাবার সম্ভাবনা হবে, যাতে আখেরে সবারই ক্ষতি হতে পারে।           
পরের কিস্তির লিংক: http://maitreesh.blogspot.com/2014/10/blog-post.html