আগের পোস্টের লিংক: http://maitreesh.blogspot.com/2014/09/blog-post.html
আগের দুই পোস্টে অসাম্যের কতগুলো উদাহরণ দিয়েছি।
তাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা উঠে এসেছে - সুযোগের বনাম ফলাফলের অসাম্য। এই ব্যাপারটা আরেকটু তলিয়ে ভাবা যাক। জীবনযাত্রার মানের যে কোন মাত্রা নিয়েই ভাবিনা কেন (আয় বা জীবন নিয়ে তৃপ্তিবোধ), অধিকতর সফল বা সুখী হবার পেছনে যে উপাদানগুলোর ভূমিকা আছে, তাদের আমরা চার ভাগে ভাগ করতে পারি – পরিবেশ (সামাজিক-অর্থনৈতিক-পারিবারিক), ব্যক্তিগত দক্ষতা বা গুণাবলী, নিজস্ব প্রচেষ্টা, এবং এসবের বাইরে আর যত যদৃচ্ছ (random) উপাদান আছে, যাদের একত্র করে আমরা চলতি ভাষায় ভাগ্য বলতে পারি।
বাকি সব উপাদানগুলো এক রেখে, যে সহায়ক পরিবেশে বড় হয়ে ওঠে, সে আর্থিক বা সামাজিক বা পারিবারিক যে দিক থেকেই হোক, তার সফল হবার সুযোগ যে সহায়ক পরিবেশ পায়নি, তার থেকে বেশি। যেমন, দরিদ্র পরিবারে জন্মের কারণে সুযোগের অভাবে যে প্রতিভার যথাযথ বিকাশ হতে পারেনা, এর উদাহরণ আমাদের চারপাশে অজস্র। একইভাবে, বাকি সব এক উপাদান এক রেখে যার দক্ষতা (যেমন, খেলোয়াড় বা লেখকের ক্ষেত্রে প্রতিভা) বা কোন গুণ বেশি (যেমন, সৌন্দর্য বা স্বাস্থ্য) সে সাফল্যের প্রাসঙ্গিক নিরিখে (আয়, যশ, সুখ) বেশি সফল হবে। আর, সব কিছু সহায়ক হলেও, পরিশ্রম বা উদ্যোগ না থাকলে, সাফল্য আয়ত্ত হবেনা, এ তো আমরা ছোটবেলা থেকে মা-বাবা-শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে শুনে আসছি। ভাগ্যের মধ্যে এমন সব উপাদান রাখছি যার ওপর কারোর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই এবং বাকি উপাদানগুলির সাথে তাদের কোন কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। একজন প্রতিভাবান মানুষ যথেষ্ট সহায়ক পরিবেশে বড় হয়ে এবং নিজে যথেষ্ট পরিশ্রম করেও সফল না হতে পারেন, ভাগ্য সহায় না হলে। দুর্ভাগ্যের উদাহরণ পরীক্ষার আগের দিন জ্বর হওয়া বা দুর্ঘটনায় পড়া, এবং সৌভাগ্যের সুপরিচিত উদাহরণ হল ঠিক সময়ে ঠিক স্থানে উপস্থিত থাকতে পারা।
প্রস্তাবিত শ্রেণীবিভাগের পক্ষে যুক্তি হল, প্রথমে একজন ব্যক্তির সাফল্যে বা জীবনযাত্রার মানে তার নিজের ভূমিকা কতটা আর বহির্ভূত উপাদানগুলোর ভূমিকা কতটা এটা আলাদা করে নিলে অসাম্যের প্রতিকারের সম্ভাব্য পথ আছে কি না, আর থাকলে সেটা কি, এগুলো নিয়ে ভাবতে সুবিধে হয়। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, ফলাফলের অসাম্যে একজন ব্যক্তির নিজস্ব দায়িত্ব কতটা সেটাকে বাকি উপাদানগুলো থেকে আলাদা করা উচিত। নিজের ভূমিকার মধ্যে দক্ষতা এবং উদ্যোগের প্রভাব আলাদা করা উচিত, কারণ একটা হল জন্মসূত্রে পাওয়া, অর্জিত নয়, আরেকটা হল নিজস্ব উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার ফল, যার কমবেশির দায় ব্যক্তির ওপরে বর্তায় । চর্চার ফলে দক্ষতা বাড়তে পারে, সেক্ষেত্রে দক্ষতা বলতে আমরা স্বাভাবিক দক্ষতার কথা ভাবব। আর বহির্ভূত উপাদানগুলোর মধ্যে, যাদের নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়, এবং নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভাবা যেতে পারে (তা বাস্তবসম্মত বা কাম্য হোক বা না হোক) তাদের সাথে সব হিসেবের বাইরে যে সব উপাদান, যাকে আমরা ভাগ্য বলছি, তাদের আলাদা করা উচিত।
একথা ঠিক, যে এই চারটে উপাদানগুলোকে সব সময়ে আলাদা করা যায়না। যেমন, কেউ কেউ মনে করবেন প্রতিভাও সৌভাগ্যের উদাহরণ – প্রকৃতির নিজস্ব লটারি আর বংশগতির প্রভাব। অথবা, সাফল্যের ক্ষেত্রে দক্ষতা ও পরিশ্রমের ভূমিকাকে সেইভাবে আলাদা করা যায়না। সেইরকম, ভাগ্য সচরাচর উদ্যমীদেরই সহায় হয়। এই জটিলতাগুলো প্রাসঙ্গিক এবং কিছুক্ষেত্রে এর ফলে আমাদের সিদ্ধান্ত একটু আলাদাও হতে পারে। যেমন, সত্যি যদি আমরা ভাবি প্রতিভা এমন কোন সম্পদ নয় যার মূল্য তার মালিকের ন্যায্যত প্রাপ্য, নেহাতই ভাগ্যের উদাহরণ, তাহলে জমি-জমার মত প্রতিভার ওপরেও কর বসানর কথা ভাবা যেতে পারে, যতই তা অবাস্তব (বা অন্যায্য) শোনাক । আমাদের প্রস্তাবিত এই শ্রেনীবিভাগের পক্ষে যুক্তি হল নেহাতই আলোচনার সুবিধা, আর কিছু না।
এবার ফিরে আসি প্রথম কিস্তিতে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোতে। ভাবা যাক, এই ধরণের যে সব বৈষম্য, সেগুলো কোন নীতির মাধ্যমে কমাবার চেষ্টা করা উচিত কি না ? সেই সব নীতি কি নির্দিষ্ট রূপ নেবে, বা এইরকম নীতির কথা ভাবা আদৌ বাস্তবসম্মত কিনা সেটা আপাতত ভাবছিনা । এখন কে এই নীতি প্রবর্তন করবে, তার নিজস্ব অবস্থার ওপরে তার দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর করতে পারে। আপনি যদি জানেন আপনি “সফল” বা “সম্পন্ন” দের দলে, তাহলে আপনার নিজস্ব স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে ইচ্ছে নাই করতে পারে। তখন আপনার মনে হবে, এই আয় তো আমার পরিশ্রম বা মেধার ফল, বা এই সম্পদ তো আমার পূর্বপুরুষের পরিশ্রম ও সঞ্চয়ের ফল, এর ওপর বেশি হারে কর আরোপ করা তো অন্যায়। সেইরকম আপনি যদি “ব্যর্থ” বা “বঞ্চিত”দের দলে, আপনার উল্টোটা মনে হতেই পারে – ধনীর ধন হল অন্যায় সুবিধা ভোগ করার বা দরিদ্রকে শোষণ করার ফল, তার ওপর বেশি হারে কর আরোপ করাই যথাযথ। এই জটিলতা এড়িয়ে যাবার জন্যে দার্শনিক জন রল্স্ (John Rawls) একটা চমৎকার উপায় বার করেছেন, যাকে অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠন (veil of ignorance) বলা হয় । ধরে নিন আপনি জন্মের আগের কোন ছায়াপৃথিবীতে আছেন, যাকে দর্শনের ভাষায় আদি অবস্থান (original position) বলা হয়, যেখানে আপনি পুরোপুরি সচেতন এবং চিন্তা করতে সক্ষম কিন্তু জন্মের পর আপনার পরিস্থিতি কি হবে তার সম্পর্কে কিছু জানেননা। ফলে আপনাকে খানিকটা নিরপেক্ষ হতেই হবে, কারণ জানেন তো না আপনার নির্বাচিত নীতিতে আপনার ভবিষ্যৎ সত্ত্বার ভালো হবে না মন্দ হবে। আপনি যদি ভাবেন, হ্যাঁ সুন্দর লোকেদের বেশি কর দেওয়া উচিত, ভাগ্যের খেলায় আপনি যদি সুন্দর হয়ে জন্মান, সেই কর আপনাকেও দিতে হবে এবং তার অন্যায্যতা নিয়ে গজগজ করার প্রবণতাও হবে, এ সবই ভেবে রাখা উচিত।
সাধারণত প্রগতিশীল কর ব্যবস্থার মাধ্যমে আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রধান যে দুই স্তম্ভ, সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং সামাজিক নিরাপত্তা জাল (social safety net), এদের সংস্থানের সমর্থনে রল্সের যুক্তি ব্যবহার করা হয়। যুক্তিটা খানিকটা বীমার যুক্তির মত – ভবিষ্যতে আপনার কোন ক্ষতি হতেও পারে নাও হতে পারে, আপনি সেটা জানেননা। আজকে বসে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সম্পূর্ণ ছেড়ে না দিয়ে, আপনি এমন এক বীমার প্রকল্পে রাজি হতে পারেন, যাতে আপনার ভাগ্য খারাপ হলে আপনি সহায়তা পাবেন। কিন্তু এই সুবিধের জন্যে আপনাকে মূল্য দিতে হবে, এবং সেটা হল, আপনার ভাগ্য খারাপ না হলেও আপনাকে কিস্তির টাকা দিয়ে যেতে হবে। তখন মনে হতেই পারে, কেন দিচ্ছি, আর ঠিক তাই এই প্রকল্পে রাজি যদি হতে চান হতে হবে অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠনের আড়ালে। এই অবগুণ্ঠন সরে গেলে যা বাস্তবে হবে সৌভাগ্যবানেদের থেকে দুর্ভাগ্যবানেদের প্রতি অর্থের হস্তান্তর, আসলে তা যেন আপনারই সম্ভাব্য দুই জীবনপথের দুই সত্তার মধ্যে লেনদেন।
এবার ধরে নেওয়া যাক রল্সের এই জন্মের আগের কুয়াশাবৃত এক প্ল্যাটফর্মে জীবনের রেলগাড়ির অপেক্ষায় বসে আমরা সবাই এই আলোচনা করছি, এবং আমাদের হাতে ভুতের রাজার বর আছে, যে আমরা আলোচনা করে যে নীতিই বেছে নেব, সেটারই প্রবর্তন হবে। এবার লেখার গোড়ায় তোলা প্রশ্নগুচ্ছে ফিরে আসি। আপনার মনে হয় কি উত্তর বেছে নেওয়া হবে এই মিটিঙে? অনুমান করছি প্রত্যেকটা প্রশ্নরই উত্তর হল, না। ভেবে দেখা যাক কেন।
প্রথম যুক্তিটা হল অর্থনৈতিক দক্ষতার (economic efficiency) যুক্তি। বৈষয়িক প্রণোদনার ফলে মানুষ বেশি কাজ করার উৎসাহ পায়, এবং তাতে অর্থনৈতিক দক্ষতা বাড়ে, আর বৈষয়িক প্রণোদনার ধারণাটির মধ্যেই ফলাফলের অসাম্য নিহিত আছে। যে পরিশ্রম বেশি করবে, সে যদি সেই অনুপাতে ফল না লাভ করে, কেউই পরিশ্রম করতে চাইবেনা। তাতে সমাজের সার্বিক উৎপাদনশীলতা কমতে বাধ্য। আমাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল খেলা নিয়ে। সেই উদাহরণ অনুযায়ী যদি সব খেলায় বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের সবার মধ্যে ফলাফল সমান করে দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিযোগীদের উৎকর্ষের সাধনায় উদ্যম বা উদ্দীপনাও কমে যাবে। আর আর্থিক দক্ষতা কমে যাবার তুলনা টানলে, সব খেলা ড্র হলে, বা সব প্রতিযোগিতায় সবাই সমান ভালো করলে খেলা বা প্রতিযোগিতার মজা বা উত্তেজনাটাই হারিয়ে যাবে, দর্শকেরা উৎসাহ হারাবে। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, যশ বা প্রতিভার অসাম্যের প্রতিকার করা উচিত কিনা। এখানেও সমস্যা হল, তার ফলে সার্বিক দক্ষতা হ্রাস পাবে। বিখ্যাত লেখক লেখায় উৎসাহ পাবেননা, অঙ্কে ভাল ছাত্র পরিশ্রম করতে চাইবেনা। অর্থনীতির ক্ষেত্রে উদ্যোগ ও পরিশ্রম বাড়াবার জন্যে বৈষয়িক প্রণোদনার ভূমিকা নিয়ে প্রায় সবাই একমত । তবে, বৈষয়িক প্রণোদনার মাত্রা বা ধরন নিয়ে বিতর্ক আছে। কর্মের ফল নিয়ে কোন বৈষয়িক প্রণোদনা বা দায়বদ্ধতা না থাকলে সরকারি অফিসের “আসি যাই মাইনে পাই” ধরণের মনোবৃত্তি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে, তাতে উৎপাদনশীলতার ক্ষতি হবে। আবার অত্যধিক বৈষয়িক প্রণোদনা থাকলে ব্যক্তিগত লাভের সাথে সামাজিক ক্ষতির (যেমন অবাধ শিল্পায়নের ফলে পরিবেশ দূষণ) সম্ভাবনা তৈরি হবে, তা বেসরকারি ক্ষেত্রে অনেক সময়েই দেখা যায় । আগেই বলেছি, আয়কর নিয়েও একইভাবে ভাবা যেতে পারে – করের হার খুব বেশি হলে, মানুষ কাজ করার উদ্দীপনা হারাবে। কিন্তু করের হার খুব কম হলেও সমস্যা আছে। পরিকাঠামো থেকে আইনশৃঙ্খলা, এই সম্পূরক উপাদানগুলো ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্দীপনা যাই হোকনা কেন সার্বিক উৎপাদনশীলতা বেশি হতে পারবেনা, আর এগুলোর যেহেতু খরচ আছে, তাই করের মাধ্যমে ন্যূনতম রাজস্বের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
দ্বিতীয় যুক্তিটা হল, মেধাতন্ত্রের যুক্তি। সমান কাজের জন্যে সমান আয়, এবং বেশি কাজ করলে সেই অনুপাতে বেশি আয় প্রাপ্য। এখন সবার দক্ষতা যদি সমান হয়, এবং ভাগ্য বা পরিবেশের কোন প্রভাব না থাকে, তাহলে এই যুক্তির বিরোধিতা করা মুশকিল। কারণ, এখানে ফলের একমাত্র নিয়ন্ত্রক হল পরিশ্রম। পরিশ্রম হল ব্যয়ের মত, আয় থেকে ব্যয় বিয়োগ না করে আয় সমান করে দিলে, যে ব্যয় বেশি করেছে, তার সাথে অন্যায় হল। অন্যায় তখনই হবে যখন সমান পরিশ্রম করে সমান ফল উৎপাদন করা সত্ত্বেও দুজনের আয় যদি আলাদা হয়। দক্ষতা বা প্রতিভার ফারাক থাকলে, ব্যাপারটা আরেকটু তলিয়ে ভাবতে হবে। একই কাজ করতে দক্ষ একজনের কম সময় বা পরিশ্রম লাগবে, অথবা, কাজের যে পরিণাম, তার উৎকর্ষ বেশি হবে। এখানে আয় যদি ফলের ওপর ভিত্তি করে, তাহলে যে বেশি দক্ষ, সে অধিকতর লাভবান হবে, কারণ হয় তার একই কাজ করতে কম পরিশ্রম করতে হবে, নয়তো তার কাজের ফলের উৎকর্ষের জন্যে, একই সময় কাজ করে, তার আয় (বা যশ) বেশি হবে। এই ক্ষেত্রে মেধাতন্ত্রের যুক্তি হল দক্ষতা বা প্রতিভা তো কোন অন্যায্য উপায়ে পাওয়া সম্পদ না, যে তার ওপর কর বসাতে হবে? এই যুক্তিটা ন্যায়েরই (fairness) যুক্তি। প্রতিভা বা দক্ষতার কদর হওয়া উচিত। যে সত্যি ভালো খেলে, তারই তো জেতা উচিত। যিনি প্রতিভাবান লেখক, তাঁরই তো যশ প্রাপ্য। যে অঙ্কের ভালো ছাত্র, তারই তো অঙ্ক-পরীক্ষায় প্রথম হওয়া উচিত। এই ভাবনাকে আমরা উৎকর্ষের সম্মান বা মেধাতন্ত্র বলতে পারি। কেউ সৎপথে নিয়ম মেনে ভালো করলে, তা নিয়ে কার কি বলবার আছে? আমাদের তখনই ক্ষোভ হয় যখন কেউ অসৎপথে খেলায় জেতে, বা অন্যায় সুবিধা পায় বা তদ্বির-চাটুকারিতা-উৎকোচের সহায়তায় সফল হয়। নিয়ম মেনে খেলা হলে, হেরে গেলে মন খারাপ হতে পারে, কিন্তু সেই ফলাফলকে অন্যায্য ভেবে বিক্ষোভ হয়না।
তৃতীয় যুক্তিটা হল ব্যক্তিস্বাধীনতার যুক্তি। স্বাধীন নাগরিক হিসেবে দেশ বা সমাজ বা সরকার আমাদের মালিক নয়, তাই আমাদের অধিকার খর্ব করে এমন যে কোন নীতি চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে এই যুক্তিটা প্রয়োগ করা যেতে পারে। কর ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি হল, নিরাপত্তা, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, এবং পরিকাঠামো তৈরি করা ও বজায় রাখার খরচ আছে। অথচ এগুলো ছাড়া শুধু ব্যাক্তিগত উদ্যোগে অর্থনৈতিক সম্পদ সৃষ্টি হতে পারেনা । তাই এই খরচের ভাগ সবাইকে সাধ্যমত দিতে হবে, এবং যার সাধ্য বেশি, সে বেশি কর দেবে। কিন্তু অতি-উদারবাদীদের (libertarian) মতে সরকারের ন্যূনতম এইসব দায়িত্ব পালনে যে খরচ, তা মেটানোর প্রয়োজন বাদ দিলে নাগরিকদের আয় বা সম্পদের পুনর্বণ্টনের আর কোন নৈতিক অধিকার সরকারের নেই, কারণ তা ব্যক্তিস্বাধীনতায় অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ। আয় বা সম্পদের মালিকানা ব্যক্তির, সেখানে সে কর দিতে পারে (এবং করের হার বেশি মনে হলে সে অন্য রাজ্যে বা দেশে চলে যেতে পারে) কিন্তু এর বাইরে তার সম্পদ বা আয়ে দখলদারি করা জোরজবরদস্তির (coercion) সমান, এবং তার অধিকার সরকারের বা অন্য কারোর নেই। ন্যায্য কর দেবার পর আমার যদি বেশি আয় বা সম্পদ থাকে, সেটা আমার ব্যাপার, তাতে আর কারোর ঈর্ষা হতেই পারে, কিন্তু সেটা কেড়ে নেবার অধিকার নেই। আর, মানুষের যে সম্পদ বস্তুগত বা আর্থিক নয় (যেমন, মাতা-পিতার শিক্ষা বা রূপ বা স্বাস্থ্য), প্রাকৃতিক বা জন্মগত কারণে পাওয়া, সেখানে সমতার কাঁচি চালিয়ে সব সমান করে দেবার ইচ্ছেটাই তো অদ্ভুত। আমাদের এই আলোচনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতার এই যুক্তিটাকে আমরা খানিকটা এড়াতে পারি। কারণ, এখানে ধরেই নেওয়া হচ্ছে, অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠনের আড়ালে বসে স্বেচ্ছায় আমরা এই নীতিগুলোর সম্ভাব্য প্রবর্তন আলোচনা করছি। অর্থাৎ, এই আলোচনার ফলে আমরা যদি প্রশাসন চালানর জন্যে যে ন্যূনতম খরচের প্রয়োজন, তার ভাগ দেবার প্রয়োজনের থেকে বাড়তি কোন আয় বা সম্পদের পুনর্বণ্টনের নীতি স্বেচ্ছায় অবলম্বন করতে রাজি হই (যেমন ধরা যাক ঠিক হল যে, আমাদের মধ্যে কেউ দুর্ঘটনার শিকার হলে, সে সরকারি সাহায্য পাবে), তাহলে তো আর জোরজবরদস্তির অভিযোগটা খাটেনা। তাহলেও আয় বা অর্থসম্পদ বাদ দিয়ে অন্য যে নানা সম্পদ এবং সাফল্যের সূচকের উদাহরণ আছে সেগুলোতে হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে একটা অস্বস্তি থেকে যায়। প্রশ্ন হল, কেন? এক হতে পারে এগুলো আয় বা সম্পদের মত নৈর্ব্যক্তিক ভাবে মাপা এবং তার ওপর নীতি নির্ধারণ করা বাস্তবসম্মত নয়। আরেকটা যুক্তি হল, মানুষের বাহ্যিক সম্পদ এবং তার নিজস্ব শ্রমশক্তি, গুণাবলী এবং মানবসম্পদের মধ্যে একটা বড় তফাৎ আছে। প্রথমটির ওপর মানুষের কোন স্বাভাবিক (natural) অধিকার নেই, যদিও আইনি অধিকার থাকতে পারে, কিন্তু অন্যগুলির ওপর তার অবিচ্ছেদ্য (inalienable) অধিকার। তার লঙ্ঘন করা দাসপ্রথার সাথে তুলনীয়। অতি-উদারপন্থীরা (যেমন, রবার্ট নজিক) অনেক সময় সরকারের তরফ থেকে আয়-কর এবং বাধ্যতামূলক শ্রম দাবি করার মধ্যে কোন ফারাক নেই বলে দাবি করেন । এর বিপক্ষে দুটি যুক্তি আছে। প্রথমত, আয় হল শ্রমের ফলাফল, এবং করের কারণে কেউ যদি কম পরিশ্রম করতে চান তাঁর সে অধিকার আছে, যা বাধ্যতামূলক শ্রমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। দ্বিতীয়ত, কি ভাবে কোন পেশায় শ্রম নিয়োজিত হবে তা নির্ধারণ করার অধিকার থাকলে, তা অর্থনৈতিক দক্ষতা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা, দুই দিক থেকেই বাধ্যতামূলক শ্রমের চাইতে শ্রেয়। এখানে বলে রাখা ভালো, উদারবাদী (liberal) আর অতি-উদারবাদীদের (libertarian) মধ্যে ফারাক হল, দুই পক্ষই ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী কিন্তু প্রথম মতধারায় সেই স্বাধীনতারক্ষায় সরকারের বড় ভূমিকা আছে, আর দ্বিতীয় মতধারায়, সরকারের ভূমিকা যত কম হবে ততই মঙ্গল বলে মনে করা হয়। আরেকটা তফাৎ হল, উদারবাদীরা সুযোগের সাম্যের জন্যে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা মেনে নেন, আর অতি-উদারবাদীরা জোর দেন ব্যক্তির জীবনে যে কোনধরণের হস্তক্ষেপেরই (তার মধ্যে সুযোগের সাম্য বৃদ্ধির জন্যে প্রয়োজনীয় পুনর্বণ্টনও পড়ে) বিরোধীতায়।
এই পোস্টে অসাম্যের উদাহরণগুলো ইচ্ছে করেই এমন ভাবে নির্বাচন করেছি, যে সেগুলো দূর করার পক্ষে যুক্তি খাড়া করা মুশকিল, সে নীতির দিক থেকেই হোক বা সম্ভবপরতার দিক থেকে। বরং, অসাম্য মেনে নেবার স্বপক্ষে (বা পুনর্বণ্টনের বিরুদ্ধে) আমরা গোটা কয়েক যুক্তি পেশ করেছি, সেগুলো হল আর্থিক দক্ষতা, মেধাতন্ত্র, এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার সম্মান। পরের কিস্তিতে সুকান্তর ছড়ার পটভূমিতে, অসাম্যের বিপক্ষের যুক্তি গুলো আলোচনা করব।
পরের কিস্তির লিংক: http://maitreesh.blogspot.com/2014/09/blog-post_23.html
আগের দুই পোস্টে অসাম্যের কতগুলো উদাহরণ দিয়েছি।
তাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা উঠে এসেছে - সুযোগের বনাম ফলাফলের অসাম্য। এই ব্যাপারটা আরেকটু তলিয়ে ভাবা যাক। জীবনযাত্রার মানের যে কোন মাত্রা নিয়েই ভাবিনা কেন (আয় বা জীবন নিয়ে তৃপ্তিবোধ), অধিকতর সফল বা সুখী হবার পেছনে যে উপাদানগুলোর ভূমিকা আছে, তাদের আমরা চার ভাগে ভাগ করতে পারি – পরিবেশ (সামাজিক-অর্থনৈতিক-পারিবারিক), ব্যক্তিগত দক্ষতা বা গুণাবলী, নিজস্ব প্রচেষ্টা, এবং এসবের বাইরে আর যত যদৃচ্ছ (random) উপাদান আছে, যাদের একত্র করে আমরা চলতি ভাষায় ভাগ্য বলতে পারি।
বাকি সব উপাদানগুলো এক রেখে, যে সহায়ক পরিবেশে বড় হয়ে ওঠে, সে আর্থিক বা সামাজিক বা পারিবারিক যে দিক থেকেই হোক, তার সফল হবার সুযোগ যে সহায়ক পরিবেশ পায়নি, তার থেকে বেশি। যেমন, দরিদ্র পরিবারে জন্মের কারণে সুযোগের অভাবে যে প্রতিভার যথাযথ বিকাশ হতে পারেনা, এর উদাহরণ আমাদের চারপাশে অজস্র। একইভাবে, বাকি সব এক উপাদান এক রেখে যার দক্ষতা (যেমন, খেলোয়াড় বা লেখকের ক্ষেত্রে প্রতিভা) বা কোন গুণ বেশি (যেমন, সৌন্দর্য বা স্বাস্থ্য) সে সাফল্যের প্রাসঙ্গিক নিরিখে (আয়, যশ, সুখ) বেশি সফল হবে। আর, সব কিছু সহায়ক হলেও, পরিশ্রম বা উদ্যোগ না থাকলে, সাফল্য আয়ত্ত হবেনা, এ তো আমরা ছোটবেলা থেকে মা-বাবা-শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে শুনে আসছি। ভাগ্যের মধ্যে এমন সব উপাদান রাখছি যার ওপর কারোর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই এবং বাকি উপাদানগুলির সাথে তাদের কোন কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। একজন প্রতিভাবান মানুষ যথেষ্ট সহায়ক পরিবেশে বড় হয়ে এবং নিজে যথেষ্ট পরিশ্রম করেও সফল না হতে পারেন, ভাগ্য সহায় না হলে। দুর্ভাগ্যের উদাহরণ পরীক্ষার আগের দিন জ্বর হওয়া বা দুর্ঘটনায় পড়া, এবং সৌভাগ্যের সুপরিচিত উদাহরণ হল ঠিক সময়ে ঠিক স্থানে উপস্থিত থাকতে পারা।
প্রস্তাবিত শ্রেণীবিভাগের পক্ষে যুক্তি হল, প্রথমে একজন ব্যক্তির সাফল্যে বা জীবনযাত্রার মানে তার নিজের ভূমিকা কতটা আর বহির্ভূত উপাদানগুলোর ভূমিকা কতটা এটা আলাদা করে নিলে অসাম্যের প্রতিকারের সম্ভাব্য পথ আছে কি না, আর থাকলে সেটা কি, এগুলো নিয়ে ভাবতে সুবিধে হয়। আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, ফলাফলের অসাম্যে একজন ব্যক্তির নিজস্ব দায়িত্ব কতটা সেটাকে বাকি উপাদানগুলো থেকে আলাদা করা উচিত। নিজের ভূমিকার মধ্যে দক্ষতা এবং উদ্যোগের প্রভাব আলাদা করা উচিত, কারণ একটা হল জন্মসূত্রে পাওয়া, অর্জিত নয়, আরেকটা হল নিজস্ব উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার ফল, যার কমবেশির দায় ব্যক্তির ওপরে বর্তায় । চর্চার ফলে দক্ষতা বাড়তে পারে, সেক্ষেত্রে দক্ষতা বলতে আমরা স্বাভাবিক দক্ষতার কথা ভাবব। আর বহির্ভূত উপাদানগুলোর মধ্যে, যাদের নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়, এবং নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভাবা যেতে পারে (তা বাস্তবসম্মত বা কাম্য হোক বা না হোক) তাদের সাথে সব হিসেবের বাইরে যে সব উপাদান, যাকে আমরা ভাগ্য বলছি, তাদের আলাদা করা উচিত।
একথা ঠিক, যে এই চারটে উপাদানগুলোকে সব সময়ে আলাদা করা যায়না। যেমন, কেউ কেউ মনে করবেন প্রতিভাও সৌভাগ্যের উদাহরণ – প্রকৃতির নিজস্ব লটারি আর বংশগতির প্রভাব। অথবা, সাফল্যের ক্ষেত্রে দক্ষতা ও পরিশ্রমের ভূমিকাকে সেইভাবে আলাদা করা যায়না। সেইরকম, ভাগ্য সচরাচর উদ্যমীদেরই সহায় হয়। এই জটিলতাগুলো প্রাসঙ্গিক এবং কিছুক্ষেত্রে এর ফলে আমাদের সিদ্ধান্ত একটু আলাদাও হতে পারে। যেমন, সত্যি যদি আমরা ভাবি প্রতিভা এমন কোন সম্পদ নয় যার মূল্য তার মালিকের ন্যায্যত প্রাপ্য, নেহাতই ভাগ্যের উদাহরণ, তাহলে জমি-জমার মত প্রতিভার ওপরেও কর বসানর কথা ভাবা যেতে পারে, যতই তা অবাস্তব (বা অন্যায্য) শোনাক । আমাদের প্রস্তাবিত এই শ্রেনীবিভাগের পক্ষে যুক্তি হল নেহাতই আলোচনার সুবিধা, আর কিছু না।
এবার ফিরে আসি প্রথম কিস্তিতে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোতে। ভাবা যাক, এই ধরণের যে সব বৈষম্য, সেগুলো কোন নীতির মাধ্যমে কমাবার চেষ্টা করা উচিত কি না ? সেই সব নীতি কি নির্দিষ্ট রূপ নেবে, বা এইরকম নীতির কথা ভাবা আদৌ বাস্তবসম্মত কিনা সেটা আপাতত ভাবছিনা । এখন কে এই নীতি প্রবর্তন করবে, তার নিজস্ব অবস্থার ওপরে তার দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর করতে পারে। আপনি যদি জানেন আপনি “সফল” বা “সম্পন্ন” দের দলে, তাহলে আপনার নিজস্ব স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে ইচ্ছে নাই করতে পারে। তখন আপনার মনে হবে, এই আয় তো আমার পরিশ্রম বা মেধার ফল, বা এই সম্পদ তো আমার পূর্বপুরুষের পরিশ্রম ও সঞ্চয়ের ফল, এর ওপর বেশি হারে কর আরোপ করা তো অন্যায়। সেইরকম আপনি যদি “ব্যর্থ” বা “বঞ্চিত”দের দলে, আপনার উল্টোটা মনে হতেই পারে – ধনীর ধন হল অন্যায় সুবিধা ভোগ করার বা দরিদ্রকে শোষণ করার ফল, তার ওপর বেশি হারে কর আরোপ করাই যথাযথ। এই জটিলতা এড়িয়ে যাবার জন্যে দার্শনিক জন রল্স্ (John Rawls) একটা চমৎকার উপায় বার করেছেন, যাকে অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠন (veil of ignorance) বলা হয় । ধরে নিন আপনি জন্মের আগের কোন ছায়াপৃথিবীতে আছেন, যাকে দর্শনের ভাষায় আদি অবস্থান (original position) বলা হয়, যেখানে আপনি পুরোপুরি সচেতন এবং চিন্তা করতে সক্ষম কিন্তু জন্মের পর আপনার পরিস্থিতি কি হবে তার সম্পর্কে কিছু জানেননা। ফলে আপনাকে খানিকটা নিরপেক্ষ হতেই হবে, কারণ জানেন তো না আপনার নির্বাচিত নীতিতে আপনার ভবিষ্যৎ সত্ত্বার ভালো হবে না মন্দ হবে। আপনি যদি ভাবেন, হ্যাঁ সুন্দর লোকেদের বেশি কর দেওয়া উচিত, ভাগ্যের খেলায় আপনি যদি সুন্দর হয়ে জন্মান, সেই কর আপনাকেও দিতে হবে এবং তার অন্যায্যতা নিয়ে গজগজ করার প্রবণতাও হবে, এ সবই ভেবে রাখা উচিত।
সাধারণত প্রগতিশীল কর ব্যবস্থার মাধ্যমে আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রধান যে দুই স্তম্ভ, সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং সামাজিক নিরাপত্তা জাল (social safety net), এদের সংস্থানের সমর্থনে রল্সের যুক্তি ব্যবহার করা হয়। যুক্তিটা খানিকটা বীমার যুক্তির মত – ভবিষ্যতে আপনার কোন ক্ষতি হতেও পারে নাও হতে পারে, আপনি সেটা জানেননা। আজকে বসে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সম্পূর্ণ ছেড়ে না দিয়ে, আপনি এমন এক বীমার প্রকল্পে রাজি হতে পারেন, যাতে আপনার ভাগ্য খারাপ হলে আপনি সহায়তা পাবেন। কিন্তু এই সুবিধের জন্যে আপনাকে মূল্য দিতে হবে, এবং সেটা হল, আপনার ভাগ্য খারাপ না হলেও আপনাকে কিস্তির টাকা দিয়ে যেতে হবে। তখন মনে হতেই পারে, কেন দিচ্ছি, আর ঠিক তাই এই প্রকল্পে রাজি যদি হতে চান হতে হবে অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠনের আড়ালে। এই অবগুণ্ঠন সরে গেলে যা বাস্তবে হবে সৌভাগ্যবানেদের থেকে দুর্ভাগ্যবানেদের প্রতি অর্থের হস্তান্তর, আসলে তা যেন আপনারই সম্ভাব্য দুই জীবনপথের দুই সত্তার মধ্যে লেনদেন।
এবার ধরে নেওয়া যাক রল্সের এই জন্মের আগের কুয়াশাবৃত এক প্ল্যাটফর্মে জীবনের রেলগাড়ির অপেক্ষায় বসে আমরা সবাই এই আলোচনা করছি, এবং আমাদের হাতে ভুতের রাজার বর আছে, যে আমরা আলোচনা করে যে নীতিই বেছে নেব, সেটারই প্রবর্তন হবে। এবার লেখার গোড়ায় তোলা প্রশ্নগুচ্ছে ফিরে আসি। আপনার মনে হয় কি উত্তর বেছে নেওয়া হবে এই মিটিঙে? অনুমান করছি প্রত্যেকটা প্রশ্নরই উত্তর হল, না। ভেবে দেখা যাক কেন।
প্রথম যুক্তিটা হল অর্থনৈতিক দক্ষতার (economic efficiency) যুক্তি। বৈষয়িক প্রণোদনার ফলে মানুষ বেশি কাজ করার উৎসাহ পায়, এবং তাতে অর্থনৈতিক দক্ষতা বাড়ে, আর বৈষয়িক প্রণোদনার ধারণাটির মধ্যেই ফলাফলের অসাম্য নিহিত আছে। যে পরিশ্রম বেশি করবে, সে যদি সেই অনুপাতে ফল না লাভ করে, কেউই পরিশ্রম করতে চাইবেনা। তাতে সমাজের সার্বিক উৎপাদনশীলতা কমতে বাধ্য। আমাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল খেলা নিয়ে। সেই উদাহরণ অনুযায়ী যদি সব খেলায় বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের সবার মধ্যে ফলাফল সমান করে দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিযোগীদের উৎকর্ষের সাধনায় উদ্যম বা উদ্দীপনাও কমে যাবে। আর আর্থিক দক্ষতা কমে যাবার তুলনা টানলে, সব খেলা ড্র হলে, বা সব প্রতিযোগিতায় সবাই সমান ভালো করলে খেলা বা প্রতিযোগিতার মজা বা উত্তেজনাটাই হারিয়ে যাবে, দর্শকেরা উৎসাহ হারাবে। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, যশ বা প্রতিভার অসাম্যের প্রতিকার করা উচিত কিনা। এখানেও সমস্যা হল, তার ফলে সার্বিক দক্ষতা হ্রাস পাবে। বিখ্যাত লেখক লেখায় উৎসাহ পাবেননা, অঙ্কে ভাল ছাত্র পরিশ্রম করতে চাইবেনা। অর্থনীতির ক্ষেত্রে উদ্যোগ ও পরিশ্রম বাড়াবার জন্যে বৈষয়িক প্রণোদনার ভূমিকা নিয়ে প্রায় সবাই একমত । তবে, বৈষয়িক প্রণোদনার মাত্রা বা ধরন নিয়ে বিতর্ক আছে। কর্মের ফল নিয়ে কোন বৈষয়িক প্রণোদনা বা দায়বদ্ধতা না থাকলে সরকারি অফিসের “আসি যাই মাইনে পাই” ধরণের মনোবৃত্তি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে, তাতে উৎপাদনশীলতার ক্ষতি হবে। আবার অত্যধিক বৈষয়িক প্রণোদনা থাকলে ব্যক্তিগত লাভের সাথে সামাজিক ক্ষতির (যেমন অবাধ শিল্পায়নের ফলে পরিবেশ দূষণ) সম্ভাবনা তৈরি হবে, তা বেসরকারি ক্ষেত্রে অনেক সময়েই দেখা যায় । আগেই বলেছি, আয়কর নিয়েও একইভাবে ভাবা যেতে পারে – করের হার খুব বেশি হলে, মানুষ কাজ করার উদ্দীপনা হারাবে। কিন্তু করের হার খুব কম হলেও সমস্যা আছে। পরিকাঠামো থেকে আইনশৃঙ্খলা, এই সম্পূরক উপাদানগুলো ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্দীপনা যাই হোকনা কেন সার্বিক উৎপাদনশীলতা বেশি হতে পারবেনা, আর এগুলোর যেহেতু খরচ আছে, তাই করের মাধ্যমে ন্যূনতম রাজস্বের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
দ্বিতীয় যুক্তিটা হল, মেধাতন্ত্রের যুক্তি। সমান কাজের জন্যে সমান আয়, এবং বেশি কাজ করলে সেই অনুপাতে বেশি আয় প্রাপ্য। এখন সবার দক্ষতা যদি সমান হয়, এবং ভাগ্য বা পরিবেশের কোন প্রভাব না থাকে, তাহলে এই যুক্তির বিরোধিতা করা মুশকিল। কারণ, এখানে ফলের একমাত্র নিয়ন্ত্রক হল পরিশ্রম। পরিশ্রম হল ব্যয়ের মত, আয় থেকে ব্যয় বিয়োগ না করে আয় সমান করে দিলে, যে ব্যয় বেশি করেছে, তার সাথে অন্যায় হল। অন্যায় তখনই হবে যখন সমান পরিশ্রম করে সমান ফল উৎপাদন করা সত্ত্বেও দুজনের আয় যদি আলাদা হয়। দক্ষতা বা প্রতিভার ফারাক থাকলে, ব্যাপারটা আরেকটু তলিয়ে ভাবতে হবে। একই কাজ করতে দক্ষ একজনের কম সময় বা পরিশ্রম লাগবে, অথবা, কাজের যে পরিণাম, তার উৎকর্ষ বেশি হবে। এখানে আয় যদি ফলের ওপর ভিত্তি করে, তাহলে যে বেশি দক্ষ, সে অধিকতর লাভবান হবে, কারণ হয় তার একই কাজ করতে কম পরিশ্রম করতে হবে, নয়তো তার কাজের ফলের উৎকর্ষের জন্যে, একই সময় কাজ করে, তার আয় (বা যশ) বেশি হবে। এই ক্ষেত্রে মেধাতন্ত্রের যুক্তি হল দক্ষতা বা প্রতিভা তো কোন অন্যায্য উপায়ে পাওয়া সম্পদ না, যে তার ওপর কর বসাতে হবে? এই যুক্তিটা ন্যায়েরই (fairness) যুক্তি। প্রতিভা বা দক্ষতার কদর হওয়া উচিত। যে সত্যি ভালো খেলে, তারই তো জেতা উচিত। যিনি প্রতিভাবান লেখক, তাঁরই তো যশ প্রাপ্য। যে অঙ্কের ভালো ছাত্র, তারই তো অঙ্ক-পরীক্ষায় প্রথম হওয়া উচিত। এই ভাবনাকে আমরা উৎকর্ষের সম্মান বা মেধাতন্ত্র বলতে পারি। কেউ সৎপথে নিয়ম মেনে ভালো করলে, তা নিয়ে কার কি বলবার আছে? আমাদের তখনই ক্ষোভ হয় যখন কেউ অসৎপথে খেলায় জেতে, বা অন্যায় সুবিধা পায় বা তদ্বির-চাটুকারিতা-উৎকোচের সহায়তায় সফল হয়। নিয়ম মেনে খেলা হলে, হেরে গেলে মন খারাপ হতে পারে, কিন্তু সেই ফলাফলকে অন্যায্য ভেবে বিক্ষোভ হয়না।
তৃতীয় যুক্তিটা হল ব্যক্তিস্বাধীনতার যুক্তি। স্বাধীন নাগরিক হিসেবে দেশ বা সমাজ বা সরকার আমাদের মালিক নয়, তাই আমাদের অধিকার খর্ব করে এমন যে কোন নীতি চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে এই যুক্তিটা প্রয়োগ করা যেতে পারে। কর ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি হল, নিরাপত্তা, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, এবং পরিকাঠামো তৈরি করা ও বজায় রাখার খরচ আছে। অথচ এগুলো ছাড়া শুধু ব্যাক্তিগত উদ্যোগে অর্থনৈতিক সম্পদ সৃষ্টি হতে পারেনা । তাই এই খরচের ভাগ সবাইকে সাধ্যমত দিতে হবে, এবং যার সাধ্য বেশি, সে বেশি কর দেবে। কিন্তু অতি-উদারবাদীদের (libertarian) মতে সরকারের ন্যূনতম এইসব দায়িত্ব পালনে যে খরচ, তা মেটানোর প্রয়োজন বাদ দিলে নাগরিকদের আয় বা সম্পদের পুনর্বণ্টনের আর কোন নৈতিক অধিকার সরকারের নেই, কারণ তা ব্যক্তিস্বাধীনতায় অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ। আয় বা সম্পদের মালিকানা ব্যক্তির, সেখানে সে কর দিতে পারে (এবং করের হার বেশি মনে হলে সে অন্য রাজ্যে বা দেশে চলে যেতে পারে) কিন্তু এর বাইরে তার সম্পদ বা আয়ে দখলদারি করা জোরজবরদস্তির (coercion) সমান, এবং তার অধিকার সরকারের বা অন্য কারোর নেই। ন্যায্য কর দেবার পর আমার যদি বেশি আয় বা সম্পদ থাকে, সেটা আমার ব্যাপার, তাতে আর কারোর ঈর্ষা হতেই পারে, কিন্তু সেটা কেড়ে নেবার অধিকার নেই। আর, মানুষের যে সম্পদ বস্তুগত বা আর্থিক নয় (যেমন, মাতা-পিতার শিক্ষা বা রূপ বা স্বাস্থ্য), প্রাকৃতিক বা জন্মগত কারণে পাওয়া, সেখানে সমতার কাঁচি চালিয়ে সব সমান করে দেবার ইচ্ছেটাই তো অদ্ভুত। আমাদের এই আলোচনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতার এই যুক্তিটাকে আমরা খানিকটা এড়াতে পারি। কারণ, এখানে ধরেই নেওয়া হচ্ছে, অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠনের আড়ালে বসে স্বেচ্ছায় আমরা এই নীতিগুলোর সম্ভাব্য প্রবর্তন আলোচনা করছি। অর্থাৎ, এই আলোচনার ফলে আমরা যদি প্রশাসন চালানর জন্যে যে ন্যূনতম খরচের প্রয়োজন, তার ভাগ দেবার প্রয়োজনের থেকে বাড়তি কোন আয় বা সম্পদের পুনর্বণ্টনের নীতি স্বেচ্ছায় অবলম্বন করতে রাজি হই (যেমন ধরা যাক ঠিক হল যে, আমাদের মধ্যে কেউ দুর্ঘটনার শিকার হলে, সে সরকারি সাহায্য পাবে), তাহলে তো আর জোরজবরদস্তির অভিযোগটা খাটেনা। তাহলেও আয় বা অর্থসম্পদ বাদ দিয়ে অন্য যে নানা সম্পদ এবং সাফল্যের সূচকের উদাহরণ আছে সেগুলোতে হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে একটা অস্বস্তি থেকে যায়। প্রশ্ন হল, কেন? এক হতে পারে এগুলো আয় বা সম্পদের মত নৈর্ব্যক্তিক ভাবে মাপা এবং তার ওপর নীতি নির্ধারণ করা বাস্তবসম্মত নয়। আরেকটা যুক্তি হল, মানুষের বাহ্যিক সম্পদ এবং তার নিজস্ব শ্রমশক্তি, গুণাবলী এবং মানবসম্পদের মধ্যে একটা বড় তফাৎ আছে। প্রথমটির ওপর মানুষের কোন স্বাভাবিক (natural) অধিকার নেই, যদিও আইনি অধিকার থাকতে পারে, কিন্তু অন্যগুলির ওপর তার অবিচ্ছেদ্য (inalienable) অধিকার। তার লঙ্ঘন করা দাসপ্রথার সাথে তুলনীয়। অতি-উদারপন্থীরা (যেমন, রবার্ট নজিক) অনেক সময় সরকারের তরফ থেকে আয়-কর এবং বাধ্যতামূলক শ্রম দাবি করার মধ্যে কোন ফারাক নেই বলে দাবি করেন । এর বিপক্ষে দুটি যুক্তি আছে। প্রথমত, আয় হল শ্রমের ফলাফল, এবং করের কারণে কেউ যদি কম পরিশ্রম করতে চান তাঁর সে অধিকার আছে, যা বাধ্যতামূলক শ্রমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। দ্বিতীয়ত, কি ভাবে কোন পেশায় শ্রম নিয়োজিত হবে তা নির্ধারণ করার অধিকার থাকলে, তা অর্থনৈতিক দক্ষতা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা, দুই দিক থেকেই বাধ্যতামূলক শ্রমের চাইতে শ্রেয়। এখানে বলে রাখা ভালো, উদারবাদী (liberal) আর অতি-উদারবাদীদের (libertarian) মধ্যে ফারাক হল, দুই পক্ষই ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী কিন্তু প্রথম মতধারায় সেই স্বাধীনতারক্ষায় সরকারের বড় ভূমিকা আছে, আর দ্বিতীয় মতধারায়, সরকারের ভূমিকা যত কম হবে ততই মঙ্গল বলে মনে করা হয়। আরেকটা তফাৎ হল, উদারবাদীরা সুযোগের সাম্যের জন্যে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা মেনে নেন, আর অতি-উদারবাদীরা জোর দেন ব্যক্তির জীবনে যে কোনধরণের হস্তক্ষেপেরই (তার মধ্যে সুযোগের সাম্য বৃদ্ধির জন্যে প্রয়োজনীয় পুনর্বণ্টনও পড়ে) বিরোধীতায়।
এই পোস্টে অসাম্যের উদাহরণগুলো ইচ্ছে করেই এমন ভাবে নির্বাচন করেছি, যে সেগুলো দূর করার পক্ষে যুক্তি খাড়া করা মুশকিল, সে নীতির দিক থেকেই হোক বা সম্ভবপরতার দিক থেকে। বরং, অসাম্য মেনে নেবার স্বপক্ষে (বা পুনর্বণ্টনের বিরুদ্ধে) আমরা গোটা কয়েক যুক্তি পেশ করেছি, সেগুলো হল আর্থিক দক্ষতা, মেধাতন্ত্র, এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার সম্মান। পরের কিস্তিতে সুকান্তর ছড়ার পটভূমিতে, অসাম্যের বিপক্ষের যুক্তি গুলো আলোচনা করব।
পরের কিস্তির লিংক: http://maitreesh.blogspot.com/2014/09/blog-post_23.html
Khub bhallaglo Maitreesh. Jante icchhe korcchhe eii bishoy-er upor bartaman bampanthi chintadhara kirokom? Asking a rather naive question, I am afraid.
ReplyDelete