Saturday, October 25, 2014

বাজারের সীমা

(অমিতাভ গুপ্তের সাথে লেখা দীর্ঘ এক প্রবন্ধের অংশ)

কেউ যদি টাকার বিনিময়ে কর্মক্ষেত্রে শারীরিক বিপদের ঝুঁকি নিতে রাজি থাকেও, তাকে কি সেই অধিকার দেওয়া চলতে পারে? অর্থের বিনিময়ে গর্ভ ভাড়া দেওয়া কি একটা বিপজ্জনক পথের প্রথম ধাপ? কেউ নিজের কিডনি বা চোখের মণি বিক্রি করতে চাইলে তাঁকে সেই অধিকার দেওয়া উচিত হবে? কেউ স্বেচ্ছা-ক্রীতদাস হতে চাইলে, অথবা কেউ বিপুল অর্থের বিনিময়ে নিজের জীবন দিয়ে অন্য কাউকে তাঁর শরীরের কোন অবশ্যপ্রয়োজনীয় অঙ্গ (যেমন, হৃৎপিণ্ড ) প্রতিস্হাপনের অধিকার দিতে চাইলে সেগুলো কি অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হওয়া বিধেয়?

এই এলোমেলো প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটা যোগসূত্র রয়েছে। প্রতিটা প্রশ্নই আসলে বাজারের পরিধি সংক্রান্ত। অর্থাৎ, বাজারের বাধানিষেধহীন বাণিজ্যকে আমরা কতখানি ঢুকতে দেব আমাদের নিতান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে, আমাদের শরীরের পরিসরে, আত্মার পরিসরেও? ব্যক্তিস্বাধীনতার যুক্তিকে কত দূর অবধি টেনে নিয়ে গেলে সেটা শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিস্বাধীনতার পথেই অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে? আবার, বাজারের মুক্ত বিনিময়ের যদি বিরোধিতা করতে চাই, সেটা কোন যুক্তিতে করব?

প্রশ্নগুলো আপাতদৃষ্টিতে অর্থনীতির হলেও, নৈতিক দর্শন, আইনশাস্ত্র, এমনকী রাজনীতিরও বটে  সেই ১৭৭৬ সালে অ্যাডাম স্মিথ সাহেব লিখে গিয়েছেন, আমরা মাংস পাওয়ার জন্য কষাইয়ের সদিচ্ছা বা মহানুভবতার ওপর নির্ভর করি না। সে নিজের স্বার্থেই মাংস বেচে। তাতে তার লাভ। "বাজারের অদৃশ্য হাত"  আমাদের প্রত্যেককে লাভের দিকে চালিত করে। কিন্তু বাজারের যুক্তি কি বাজারের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থাকে?  শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ গ্যারি বেকার, যিনি এ বছর মে মাসে মারা গেলেন, তাঁর মতে উত্তর হল "না"আমাদের ব্যক্তিগত জীবনও বাজারের নিয়মকে অগ্রাহ্য করে চলতে পারে না। বিয়ে থেকে পরিবার পরিকল্ম্পনা  সব সিদ্ধান্তই এই লাভ-ক্ষতির অঙ্কে বাঁধা। বেকারের বাজার-কেন্দ্রিক জীবনদর্শনের ভিত্তি হল মনুষ্যচরিত্র এবং বাজার সম্বন্ধে কতগুলি বিশ্বাস। এক, মানুষ খামখেয়ালি নয়, সে যে কোনও পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য মাথায় রেখে দুই, যে কোনও সিদ্ধান্তে লাভ ও ক্ষতি দুই-ই আছে, তাই সেটা নেওয়া হবে কিনা তার নীট যোগফলের ওপর নির্ভর করে তিন, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যদি স্বেচ্ছায় এবং স্বজ্ঞানে কিছু কেনাবেচা করে, তাহলে তাতে দুপক্ষেরই লাভ আছে, তাই কোনও রকম বাধা দেওয়া অনুচিত

তার মানে কি বিনিময়ের অধিকারের ওপর কোথাও কোন নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন নেই?


অনেক ভাবেই এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সম্ভব। এই লেখায় আমরা মূলধারার অর্থনীতির যুক্তি ব্যবহার করে সেই চেষ্টা করব। যে কোনও বিনিময়ই প্রকৃত প্রস্তাবে সম্পদ বণ্টনের গল্প। কী ভাবে অর্থনৈতিক সম্পদ বণ্টন করা উচিত, তার তিনটে পৃথক মাপকাঠি প্রচলিত। প্রথমটা efficiency বা কুশলতার মাপকাঠি। দ্বিতীয়টা equity বা fairness, মানে ন্যায্য বণ্টনের মাপকাঠি। তৃতীয়টা liberty বা স্বাধীনতার মাপকাঠি। এই লেখায় তিনটি মাপকাঠিরই ব্যবহার থাকবে। ফলে, গোড়ায় এই মাপকাঠি তিনটে সম্বন্ধে কয়েকটা প্রাথমিক কথা বলে রাখা যাক।[1]


কুশলতার মাপকাঠি বলবে, যে সম্পদের শ্রেষ্ঠ ব্যবহার করতে পারবে, যে কোনও অর্থনৈতিক সম্পদ তার হাতে যাওয়াই বিধেয় । যার কাছে সেই পণ্যের মূল্য সর্বাধিক, যে কোনও পণ্য তার পাওয়া উচিত । যে সম্পদের সবচেয়ে কুশলী ব্যবহার করতে পারবে, তার হাতে পৌঁছলেই সেই সম্পদের মূল্য সর্বাধিক হবে। ফলে, তার পক্ষে সেই সম্পদের আদি মালিককে এমন দাম দেওয়া সম্ভব হবে, যেটা সেই মালিকের পক্ষেও লাভজনক, আবার তার নিজের পক্ষেও। সেই দামে দুপক্ষই বিনিময়ে সম্মত হবে।

এই সহজ যুক্তির আড়ালে অবশ্য দুটো কথা চাপা পড়ে আছে। এক, যে মানুষটা এমনিতে গরিব, অন্যদের তুলনায় কোনও পণ্য তার কাছে বেশি মূল্যবান হলেও দাম দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যদের টপকে যাওয়ার আর্থিক ক্ষমতা তার নেই। ফলে, সে সম্পদটিকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে বা তার সবচেয়ে কুশলী ব্যবহার করতে সক্ষম হলেও, দারিদ্রের কারণে সেটা তার আয়ত্তের বাইরে থেকে যাবে আর দুই, ক্রেতা ও বিক্রেতা, উভয় পক্ষের কাছেই যে বিনিময় লাভজনক, কোনও তৃতীয় পক্ষের ওপর তার negative externality বা নেতিবাচক অতিক্রিয়া থাকতে পারে। আমার বাড়ি আমি প্রোমোটারকে বেচে দিলাম কিন্তু নতুন যে বহুতল হল তাতে পাড়ায় অন্যদের জলের সমস্যা হল বা শব্দদূষণ বেড়ে গেল, সেটা হল অতিক্রিয়ার উদাহরণ ফলে, কুশলতার মাপকাঠিতে হিসেব করার সময় এই নেতিবাচক অতিক্রিয়ার কথা মাথায় রাখতে হবে।

ন্যায্য বণ্টন বললে অনেক কিছুই বোঝানো যেতে পারে। যিনি কথাটি ব্যবহার করছেন, কথাটির অর্থ তাঁর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু, সেই সব মানের একটা অন্তর্নিহিত মিল রয়েছে। সেটা এই রকম ব্যক্তি-পরিচয় নির্বিশেষে সমদর্শী হওয়াসেই সমদর্শী আচরণ কোনও একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সব মানুষের প্রতি হতে পারে। ধরা যাক, কোনও দেশে খাদ্যসংকট দেখা দিল। সে সময় সমদর্শী আচরণের অর্থ, যেটুকু খাবার আছে, তার ওপর সবার সমান অধিকার স্বীকার করে নেওয়া। সেটা খাবারের সমবণ্টনের মাধ্যমে হতে পারে, "আগে-এলে-আগে-পাওয়া-যাবে"র ভিত্তিতে বণ্টন হতে পারে, অথবা লটারির মাধ্যমে বণ্টনও হতে পারে। শেষ দুটি ক্ষেত্রে সবাই খাবার পাবেন না ঠিকই, কিন্তু খাবার পাওয়ার বা না পাওয়ার সম্ভাবনা সবার ক্ষেত্রেই সমান হবে। আবার, কোনও একটি নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতেও সমদর্শী হওয়া সম্ভব। কোনও একটি পরিস্থিতিতে আমি থাকলে অন্যদের থেকে কোন আচরণটি প্রত্যাশা করতাম, সে কথা মাথায় রেখে সেই পরিস্থিতিতে থাকা মানুষদের সঙ্গে আচরণ করাও সমদর্শিতাএই ন্যায্য বণ্টনের যুক্তির বিপরীতে সবচেয়ে পরিচিত যুক্তি হল, কিছু জিনিসের ক্ষেত্রে এমন সাম্য প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। যেমন, মেধা বা প্রতিভার অসাম্য কোনও বণ্টনের মাধ্যমেই দূর হওয়ার নয়। আবার, সুখী হতে পারার ক্ষমতাও সবার সমান নয়। কাজেই, সম বণ্টনে কার উপভোগের মাত্রা কী দাঁড়াবে, সে কথাই বা কে বলবে? এ ক্ষেত্রে ন্যায্য বণ্টনের নীতিটিকে আর একটু স্পষ্ট করে নেওয়া ভাল। ফলাফলের সাম্য নয়, কিন্তু ফলাফলে পৌঁছনোর জন্য যে প্রক্রিয়া, সেটা যাতে সমদর্শী হয়, তা নিশ্চিত করাই এই মাপকাঠির মূল কথা।

তৃতীয় মাপকাঠি স্বাধীনতার। এই মাপকাঠি বলবে, আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজে করতে পারার স্বাধীনতাই সবচেয়ে জরুরি। এই দর্শনে সম্পত্তির অধিকারের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজের শরীরও সেই সম্পত্তিরই অংশ। সম্মত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের মধ্যে যে কোনও পারস্পরিক চুক্তির স্বাধীনতা এই দর্শনের মূল কথা। সেই স্বাধীনতায় কোনও বাধা পড়ুক, সেটা নিতান্তই অকাম্য। নিজের সম্পদের ওপর রাষ্ট্র বা সমাজ, কারও খবরদারিই এই মাপকাঠিতে অগ্রহণযোগ্য। এই দর্শনের ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, বিভিন্ন মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা আসলে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। ফলে, যত ক্ষণ আমার ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রয়োগ অন্য কারও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব না করছে, তত ক্ষণই সেই স্বাধীনতার প্রয়োগ সম্ভব।

এই লেখায় আমরা অধিকারের প্রশ্নটিকে consequentialist বা পরিণামবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখব। অর্থাৎ, বাজারের গুণাগুণ বিচার করা হবে মানুষের ওপর সেই বাজারের সম্পদ বণ্টনের পদ্ধতির পরিণামের মাপকাঠিতে। সব ক্ষেত্রেই যে এই পরিণাম উপভোগের মাপকাঠিতে মাপা হবে, তা নয়। আয়, দারিদ্র, স্বাস্থ্য, বা প্রত্যাশিত আয়ুর মতো সূচকও পরিণামের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এই পরিণামবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে right-based বা অধিকার-ভিত্তিক মাপকাঠির প্রাথমিক ফারাক রয়েছে। দ্বিতীয় মাপকাঠি বলবে, বাজার মানুষের কিছু প্রাথমিক অধিকার, যেমন অবাধে মেলামেশার অধিকার অথবা শিক্ষার অধিকার বা অন্য কোনও অধিকার, দিচ্ছে কি না, সেটাই মূল কথা। সেই অধিকার প্রয়োগের ফল কী দাঁড়াল, সেটা বিচার্য নয়।[ii] আরও মনে রাখা প্রয়োজন, কোনও বিকল্প বণ্টন ব্যবস্থার কথা না বলে কোনও একটি বাজারকে নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করার  গুণাগুণ বিচার করা যাবে না। যেমন, কিডনির বাজারকে নিষিদ্ধ করতে হলে তার জন্য বিকল্প কোনও ব্যবস্থার কথা বলতে হবে। যেমন, কিডনি দান, অথবা বিনিময়, অথবা যে কোনও রকম কিডনি প্রতিস্থাপনকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। প্রতিটি বিকল্পই আবার বিভিন্ন মানুষের জীবনে বিভিন্ন ভাবে প্রভাব ফেলবে।

প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের স্বেচ্ছা বিনিময়ের অধিকারের পক্ষে অর্থনীতির যে ঘরানা সবচেয়ে সরব, সেই শিকাগো স্কুলের মিলটন ফ্রিডম্যানের  মতে, যদি কোনও বিনিময়ে দুপক্ষই সম্মত হন এবং দুপক্ষের কাছেই সেই বিনিময় সংক্রান্ত পূর্ণ তথ্য থাকে, তবে সেই বিনিময় থেকে দুপক্ষই লাভবান হবেন।[iii] একটু অন্য ভাষায় বললে, মিয়া বিবি রাজি তো ক্যা করেগা কাজি? এই যুক্তির খাদ তার পূর্বশর্তে উভয় পক্ষের কাছেই বিনিময় সংক্রান্ত পূর্ণ তথ্য আছে এবং সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে সমস্ত ভালো মন্দ বিচার করে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা আছে    বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, হয় এক পক্ষের কাছে সম্পূর্ণ তথ্য নেই (হয়তো তাঁদের খবর জানার উপায় নেই, অথবা তাঁদের ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল বোঝানো হয়েছে), আর নয়তো বিনিময়ের সম্পূর্ণ তাত্পর্য বোঝা তাঁদের ক্ষমতার বাইরে। কিডনি বিক্রির ক্ষেত্রেই যেমন বহু মানুষ পরে আফসোস করেছেন, কারণ বিক্রি করার সময় তাঁরা ভাবতে পারেননি, এই সিদ্ধান্তের ফলে ভবিষ্যতে তাঁদের শারীরিক সক্ষমতা কতখানি হ্রাস পাবে। Rational choice বা যুক্তিসঙ্গত চয়নের তত্ত্ব যে ভাবে সবার কাছে সম্পূর্ণ তথ্য থাকাকে এবং সেই তথ্য ব্যবহার করে সঠিক সিদ্ধান্ত  নেওয়ার ক্ষমতাকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়, সেটা বাস্তবানুগ নয়।

আমাদের কারও কাছেই কোনও সিদ্ধান্ত এবং তার তাত্পর্য সংক্রান্ত সম্পূর্ণ তথ্য নেই। সমস্ত প্রাসঙ্গিক তথ্য হাতের কাছে থাকলেও আমরা যে সিদ্ধান্ত নিই, সবসময়  তার সমস্ত পরিণাম আমরা ভালো করে বুঝে যে নিই, তা নয় আমাদের মধ্যেই অনেকগুলো সত্তার নিত্য সংঘাত চলে, এবং এরকম ভাবার কারণ নেই যে সব সময়ে আমরা সব দিক বিবেচনা করে, এই সব সত্তার নানা দাবির মধ্যে সমঝোতা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিই যেমন, আমরা অনেক সময়েই যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই , যাহা পাই তাহা চাই না! গবেষণায় দেখে যাচ্ছে যে তাত্ক্ষণিক সুখ, প্রয়োজন বা আকর্ষণ আর  নিজের দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণের মধ্যে নিরন্তর যে দ্বন্দ্ব, বাস্তব ক্ষেত্রে মানুষ অনেক সময়েই তার সন্তোষজনক নিষ্পত্তি করে উঠতে পারে না, বর্তমানে নেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে পস্তায় ক্রমশ মূলধারার অর্থনীতিচর্চায় মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মনস্তত্ত্বের প্রভাবকে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে   আচরণবাদী অর্থনীতি (behavioural economics) বলে অর্থনীতির একটি ধারাই তৈরী হয়েছে যার মূল বিষয় হল, তত্ত্ব ও তথ্যের মাধ্যমে যুক্তিসঙ্গত চয়নের কাঠামোর বাস্তবমুখী পরিমার্জন করা [iv]

মূলধারার অর্থনীতিতে যুক্তিসঙ্গত চয়নের কাঠামোতে আরেকটা দিক থেকে কিছু পরিবর্তন এসেছে, যার মূলে আছে এই ধারণা যে কোন ব্যক্তি তো আর সমাজ বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন নয় তাই পরিবারের মধ্যে এবং তার বাইরে বৃহত্তর অর্থনৈতিক পরিসরে, এখন ব্যক্তির সিদ্ধান্তকে বিমূর্তভাবে বিশ্লেষণ করা যায়না, তার সামাজিক পরিচয় (identity) সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এর অনেক দিক আছে, যেমন, লিঙ্গ, প্রজন্ম, জাতপাত, বা সামাজিক মর্যাদা, এবং এদের যেকোনো রকমের সমন্বয় এর ফলে সবার সামনে সিদ্ধান্ত নেবার সময়ে সম্ভাব্য বিকল্পগুলো এক থাকেনা  

কিন্তু, তথ্যের অসম্পূর্ণতা, সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়ায় মনস্তত্বের প্রভাব এবং সামাজিক পরিচয়ের ভূমিকা, তিনটি বিষয়ই এত দীর্ঘপরিসর এবং গভীর যে তার যথাযথ আলোচনার জন্য একটি গোটা লেখা বরাদ্দ করাই ভাল। এই লেখায় আমরা ধরে নেব, সবার কাছে সমস্ত তথ্য রয়েছে, সবাই সেই তথ্যের সম্পূর্ণ অর্থোদ্ধারে সমর্থ, এবং সিদ্ধান্ত নেবার সময় সমস্ত রকম পরিণাম নিয়ে যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা করেই নেয়, এবং সামাজিক পরিচয়ের কোন ভূমিকা নেই সোজা কথায় বলতে গেলে,  সবাই প্রাপ্তবয়স্ক, সম্পূর্ণভাবে অবহিত, এবং নিজের ভালোমন্দ নিজেই সবচেয়ে ভালো বোঝে তাই আমাদের আলোচনার পরিসরের মধ্যে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে স্বেচ্ছা বিনিময়ের অধিকারের  হস্তক্ষেপ করার পক্ষে যুক্তি খাড়া করতে গেলে তা তাদের সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়ার মধ্যে পাওয়া যাবেনা, খুঁজতে হবে তার বাইরে সেটা তাদের সম্পর্কের মধ্যে হতে পারে, বা সেটার সাথে বৃহত্তর সমাজের পারস্পরিক অভিঘাতে হতে পারে   

বাজারের সমর্থকরা বলে থাকেন, বাজার কাউকে জোর করে না।  কেউ স্বেচ্ছায় বাজারে যোগ দিতে পারে, আবার কেউ স্বেচ্ছায় সরে থাকতে পারে সেই বাজার থেকে। মানুষ যখন নিজের ভালমন্দ বিবেচনা করে, ব্যয়-লাভের হিসেব কষে নিয়ে তবেই কোনও সিদ্ধান্ত করে, কাজেই ধরে নেওয়া যায়, যিনি বাজারে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত করছেন, তিনি তাতেই ভাল থাকছেন আর যিনি বাজার থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত করছেন, তিনি ভাল থাকছেন বাজার থেকে দূরে তাঁর নিজস্ব কোণে। অর্থাৎ, বাজার আসার আগে সবাই যতটুকু ভাল থাকছিলেন, বাজার আসার পরে কেউ কেউ ততটুকুই ভাল থাকছেন (যাঁরা বাজারে যোগ দিলেন না, তাঁরা), আর কেউ কেউ বাজারে যোগ দিয়ে আগের চেয়ে ভাল থাকছেন। মোটমাট, সবাইকে যোগ করলে সমাজের ভাল থাকার পরিমাণ আগের তুলনায় বাড়ছে, এবং সেটা বাড়ছে প্রত্যেকের ব্যক্তিস্বাধীনতা বজায় রেখেই। utilitarian বা তৃপ্তিযোগবাদীরা বলবেন, এই তো চাই!

তা হলে বাজারের বিরোধীদের মূল যুক্তিগুলো কী?

প্রথমত, যাকে চয়নের স্বাধীনতা বলে মনে হচ্ছে, তা অনেক সময়েই আসলে ঘোরতর বাধ্যবাধকতা। সামাজিক চাপ, অর্থনৈতিক চাপ, শিক্ষার অভাব, বিকল্প পেশার অভাব সব মিলিয়ে মানুষ অনেক কাজ করতে, অনেক ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন   অর্থাৎ, এই ধরনের চয়ন অসম বিনিময় বা শোষণের (exploitation) উদাহরণ   দ্বিতীয়ত,  কিছু ক্ষেত্রে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে স্বেচ্ছা বিনিময় সমাজে অন্যদের ওপর দূষণের মত প্রত্যক্ষভাবে না হলেও, পরোক্ষ প্রভাব ফেলতে পারে যেমন, কিছু ধরনের পেশা আইনি হলে (যেমন, দেহব্যবসা) অন্য ধরনের পেশায় তার প্রভাব পড়তে পারে বা, বৃহত্তর সমাজে তার কিছু অভিঘাত পড়তে পারে (যেমন, মূল্যবোধের অবক্ষয়) যা কাম্য  নয় এই যুক্তিটি  অতিক্রিয়ার (externality) এবং এর অনেক উদাহরণ এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব  তৃতীয়ত, আইন  ব্যবস্থার নানা ত্রুটি থাকায়, যা আপাতদৃষ্টিতে স্বেচ্ছা বিনিময়, তার মধ্যে অনেকসময়েই জোরজবরদস্তি  (coercion) এবং অপব্যবহারের (abuse) সম্ভাবনা থেকে যায় চতুর্থত, যেহেতু আমরা প্রথমেই ধরে নিয়েছি সবাই প্রাপ্তবয়স্ক, সম্পূর্ণ ভাবে অবহিত, এবং নিজের ভাল-মন্দ নিজেই সবচেয়ে ভালো বোঝে, তাই অবাধ বিনিময়ের (যেমন, মাদকদ্রব্যের কেনাবেচা) কিছু পরিচিত “এখন করছ, পরে কিন্তু পস্তাবে” বা “নিজের ভালো মন্দ বোঝনা” গোছের আপত্তি আমাদের আলোচনার পরিধির বাইরে [v] কিন্তু কিছু উদাহরণ অবশ্য আছে (যেমন, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করা) যেখানে সিদ্ধান্তগুলো একই সাথে এমনই অপরিবর্তনীয়  এবং তাত্পর্যপূর্ণ যে একবার ভুল সিদ্ধান্ত নিলে তার জন্যে সারা জীবন ভুগতে হয় বা, জীবন নিয়েই টানাটানি হতে পারে   আমরা এইসব ক্ষেত্রে স্বেচ্ছা বিনিময়ের অধিকার নিয়ন্ত্রণের কথা আলোচনা করব

দ্বিতীয় এবং শেষ কিস্তির লিংক: http://maitreesh.blogspot.com/2015/01/blog-post.html




[1] এই তিনটি মাপকাঠি প্রসঙ্গে আলোচনার জন্য দেখুন অমর্ত্য সেনের Markets and Freedoms: Achievements and Limitations of the Market Mechanism in Promoting Individual Freedoms, Oxford Economic Papers, October 1993
[ii] এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন Amartya Sen, The Moral Standing of Market, Social Philosophy and Policy, Spring 1985
[iii] Milton Friedman, Capitalism and Freedom, University of Chicago Press, 1962
[iv] এই নামটি একটু বিভ্রান্তিকর কারণ একদিক থেকে দেখলে অর্থনীতির সব ধারাই মানুষের আচরণ নিয়ে চর্চা করে এর সূত্র হল এই চিন্তাটি যে যুক্তিসঙ্গত চয়নের তত্ত্বের চশমা পরে নয়, আগে খালি চোখে দেখা যাক মানুষের আচরণ কী
[v] একই যুক্তিতে যে সব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক, এবং বার্ধক্য বা অসুস্থতার কারণে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সক্ষম নন এমন প্রাপ্তবয়স্করা জড়িত, সেগুলিকে আমাদের আলোচনার পরিধির বাইরে রাখছি    

No comments:

Post a Comment