আগের পোস্টের লিংক: http://maitreesh.blogspot.com/2014/09/blog-post_9.html
সুকান্ত যে ধনীদের প্রতি তাঁর তীব্র শ্লেষ নিক্ষেপ করেছেন
তার পটভূমি মনে রাখা দরকার। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি লেখা এই ছড়ার ঠিক আগে
তেতাল্লিশের মন্বন্তরে বাংলায় বহুলক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যান এবং তা রোধ করতে
ব্যর্থ হওয়ায় ঔপনিবেশিক ও আঞ্চলিক সরকারের বড় দায়িত্ব ছিল, কিন্ত তা ছাড়াও,
স্বদেশী কালোবাজারি ব্যবসায়ী, ধনী কৃষক, এবং জমিদারদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকাও
ছিল। এই জায়গা থেকে দেখলে বোঝা যায় কেন সুকান্ত লিখেছেন, “বড়লোকের ঢাক তৈরি গরীব লোকের চামড়ায়”।
ইতিহাসের বিশেষ
কোন পর্যায়ে এটাই রীতি হতেই পারে। দাস ব্যবস্থার কথা নয় বাদই দিলাম, যার অন্যায্যতা নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনা। উনবিংশ শতাব্দীর
অ্যামেরিকায়, রবার ব্যারন কথাটা ব্যবহার হত সেই সব ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি সম্পর্কে
যাঁরা অন্যায় উপায়ে ধন সঞ্চয় করতেন । তার মধ্যে সরকারকে উৎকোচ দিয়ে প্রাকৃতিক
সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, শ্রমিকদের শোষণ করা, অন্যায় উপায়ে প্রতিযোগিতার পথ বন্ধ
করা, শেয়ারের দাম ইচ্ছে করে বাড়িয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে
সেই কোম্পানি ইচ্ছে করে লাটে তুলে দেওয়া ছিল (শেষোক্ত প্রসঙ্গে পরশুরামের “শ্রী
শ্রী সিদ্ধেশ্বরী প্রাইভেট লিমিটেড” গল্পটি স্মরণীয়)। মার্ক্সের আদিম ধনসঞ্চয়ের (primitive accumulation) তত্ত্ব এখানে
মনে পড়ে যেতে বাধ্য।
সমসাময়িক ভারতের
অর্থনীতিতে এই ধরণের ডাকাত ধনপতি নেই বললে নেহাতই বাস্তবকে অস্বীকার করা হয়।
কিন্তু সব সমাজে সব ধনী যে
সব সময়ে অসৎপথেই তাঁদের সব টাকা রোজগার করেন, তাও তো বলা যায়না। অনেক সময়েই তাঁরা
নতুন কিছু উদ্ভাবন করে কিম্বা কোন পণ্য বা
পরিষেবা উৎপাদন ও যোগানের মাধ্যমে সৎপথেই লাভ অর্জন করেন। শুধু তাই নয়, এঁদের বিনিয়োগের ফলে চাকরির চাহিদা
বাড়ে, এবং মজুরি ও কর্মনিয়োগের মাধ্যমে দারিদ্র কমে। এঁদের আয়ের থেকে যে কর সংগৃহীত হয় তার ফলে
সরকারি পরিকাঠামো এবং পরিষেবার ওপর খরচ করার সামর্থ্য বাড়ে। সেই জন্যেই
দেশে-বিদেশে বাম থেকে ডান সব সরকারই বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রচেষ্টায় সদাব্যস্ত। অর্থাৎ,
ধনতন্ত্রে সব খেলা তো আর শূন্য অঙ্কের খেলা নয়, কিছু কিছু খেলা ধনাত্মক অঙ্কেরও
হয়। লাভ মানেই শোষণ এই সমীকরণ সবক্ষেত্রে নিশ্চয়ই খাটেনা। আর একটা কথা আছে। যেখানে অসাম্যের সূত্র
অন্যায্য উপায়ে আহৃত সম্পদ, সেখানে আমাদের মূল সমস্যা অসাম্য নিয়ে, না যে অন্যায়
ব্যবস্থার ফলে সেটা হয় সেটা নিয়ে? এই ক্ষেত্রে অসাম্য হল উপসর্গমাত্র, অসমান খেলার
মাঠ এবং অন্যায় খেলার নিয়ম হল মূল সমস্যা।
সেই ব্যবস্থার সংস্কার না করে ধনের পুনর্বণ্টন করলেই যে সমস্যা
মেটেনা, নতুন ডাকাত ধনপতিদের জন্ম হয় মাত্র, এর উদাহারণও ইতিহাসে প্রচুর।
দ্বিতীয়ত, এমন যদি হয় যে ধনীরা তাদের বিত্ত পরিশ্রম ও
সঞ্চয়ের মাধ্যমে সৎপথেই অর্জন করেছেন, তাহলে সরকারের ন্যূনতম ভূমিকা পালন করার যে খরচ, তার অংশ দেওয়া
ছাড়া কি আয় বা সম্পদের
পুনর্বণ্টনের স্বপক্ষে কোন যুক্তি আছে? আছে, কারণ আর সব কিছু এক রেখে আর্থিক দিক
থেকে কেউ যদি অভাবী হয়, সে তার মেধার বিকাশের সুযোগ কম পাবে, তার ক্ষেত্রে
প্রচেষ্টা ও দক্ষতার সাথে ফলাফলের সমীকরণে একটা ঘাটতি পড়ে যাবে। এখানে
মেধাতন্ত্রের যুক্তিটা খাটেনা । সবচেয়ে ভালো দল বা খেলোয়াড় জিতুক খুব ভালো কথা,
কিন্তু খেলার মাঠ তো সমান নয়। মতি নন্দীর
কোনি পাঠকের অকুণ্ঠ সমর্থন পায় কারণ তার সাথে তার স্বচ্ছল প্রতিদ্বন্দীদের সুযোগ
এবং সম্পদের বিশাল ফারাক। আমরা ক্ষিদ্দার সাথে মনে মনে বলে উঠি “ফাইট, কোনি, ফাইট”
কারণ এমন নয় যে কোনির প্রতিভা সবার থেকে অনেকটা বেশি। কারণ হল, তাকে অন্যান্য
প্রতিযোগীদের তুলনায় অনেক বেশি বাধা অতিক্রম করতে হচ্ছে। সেই বাধা দারিদ্রের, এবং তজ্জনিত সুযোগের অভাবের। এই ক্ষেত্রে খেলাটা হয়তো গট-আপ নয়, কিন্তু
প্রতিযোগীদের মধ্যে ফারাকটা শুধু দক্ষতা
আর পরিশ্রমের নয়, সুযোগেরও। অর্থাৎ অন্যায় না
হলেও এটা অসমান প্রতিযোগিতা। আরেকটা উদাহরণ নেওয়া যাক - শিশু শ্রম। শিশু
শ্রমিক হল সুযোগের অসাম্যের একটা চরম নিদর্শন । অভাবের কারণে যার পড়াশুনো হলনা,
অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় প্রথম ধাপেই সে অনেকটা পিছিয়ে পড়ল । তার মানবসম্পদ বিকশিত
না হয়ে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল। তাতে তারও ক্ষতি, সমাজেরও ক্ষতি অথচ এই ক্ষেত্রে তার
প্রত্যক্ষ কোন দায়িত্ব নেই । দরিদ্র পরিবারে
জন্ম নেওয়াটা এই দিক থেকে দেখলে নিতান্তই জীবনযুদ্ধের প্রাঙ্গনে
ঢাল-তরোয়াল-বর্ম-রথ ছাড়া সশস্ত্র সেনানীর মুখোমুখি হবার মত।
আমাদের মূল বিষয়ে
যদি ফিরে আসি, এই প্রতিবন্ধক আর্থিক হবার জন্যে আমরা যে পদ্ধতির (অজ্ঞানতার
অবগুণ্ঠন) মাধ্যমে পুনর্বণ্টনের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলোর বিচার করছি, এই
ক্ষেত্রে পক্ষের যুক্তিটা বেশ জোরদার । সমান দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও, এবং সমান
পরিশ্রম করেও কেউ যদি আর্থিক কারণে সমান সুযোগ না পায়, আর তার জন্যে সে যদি
ফলাফলের দৌড়ে পিছিয়ে পড়ে, তাহলে সেটাকে আর যাই হোক মেধাতন্ত্র বলা যায়না। উদ্যম ও
প্রচেষ্টার প্রণোদক হিসেবে এবং মেধাতন্ত্রের যুক্তিতে ফলাফলের অসাম্য যদি আমরা
মেনেও নিই, অন্তত আর্থিক সুযোগের অসাম্য
দূর করার জন্যে নীতির বিপক্ষে নৈতিক দিক থেকে খুব একটা যুক্তি নেই। আপনার মনে হতেই
পারে, ঠিক আছে, পৃথিবীতে অনেক অন্যায় আছে, কিন্তু আমার হাতে তো নাই ভুবনের ভার।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, আপনি অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠনের আড়ালে এই নীতির আলোচনা করছেন,
ভাগ্যচক্রে সুযোগের অভাবের শিকার আপনিও হতে পারেন। খেয়াল করে দেখুন, এখানে যারা সুযোগের দিক থেকে পিছিয়ে
আছে তাদের সমান সুযোগ দেবার কথা হচ্ছে, যাতে তারা সমতল ক্রীড়াঙ্গনে (level playing field)
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে । সেটা করতে গেলে নিশ্চয়ই অর্থের প্রয়োজন, এবং সেই
অর্থ নিশ্চয়ই বিত্তবান শ্রেণীর কাছ থেকেই আনুপাতিক হারে বেশি আসবে কারণ তাদের
সামর্থ্য বেশি। এখানে লক্ষ করার বিষয় হল, এই যুক্তি অনুসারে সমস্যাটা কিন্তু দারিদ্রের,
অসাম্যের নয়। যদিও বাস্তবে দারিদ্র ও অসাম্য অনেক সময়ে একইসাথে দেখা যায়, যুক্তির
দিক থেকে দেখলে তাদের মধ্যে কোন সরল সম্পর্ক নেই। দরিদ্র এমন সমাজের কথা ভাবাই যায়
যেখানে অসাম্য (অর্থাৎ ধনী-দরিদ্রের ফারাক) কম, আবার অসম সমাজের কথা ভাবা যায়,
যেখানে দারিদ্র কম। দারিদ্রের কারণে
সুযোগের যে অসাম্য, এখানে সেটা দূর করাই উদ্দেশ্য, ফলাফলের অসাম্যের বিরুদ্ধে
কিন্তু কোন নীতি নেওয়া হচ্ছেনা।
এই প্রসঙ্গে
সামাজিক বৈষম্যের কথা উল্লেখ না করলে আলোচনা নেহাতই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সুকান্ত তাঁর ছড়াটিতে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের ওপরেই মনোনিয়োগ
করেছেন, যা প্রথাগত বামপন্থী চিন্তাধারাতেও সচরাচর করা হয়ে থাকে। আর্থিক অবস্থা এক
রেখেও, সামাজিক বিধির কারণে বর্ণ-জাতি-লিঙ্গ ভেদে সবাই সমান সুযোগ পায়না। প্রতিদিন
নানা ভাবে যদি কেউ তাঁর সামাজিক অবস্থান বা লিঙ্গের কারণে নানা বাধার মুখোমুখি
হন, মেধাতন্ত্রের স্বপক্ষে যুক্তিটা দুর্বল হয়ে পড়ে। আগের অংশে আলোচনা করেছি যে মেধাতন্ত্রের একটা
প্রাথমিক শর্ত হল, সমান কাজের জন্যে সমান
আয়। সামাজিক বৈষম্যের ফলে এই শর্ত লঙ্ঘন
হয়। শুধু তাই না, এই বৈষম্যের প্রত্যাশা প্রতিভার বিকাশের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়।
মহাভারতের একলব্যের কথা আজও আমাদের পীড়া দেয় । আর
“মেয়েদের কাজ সংসার করা” বা “মেয়েরা বিজ্ঞানে কাঁচা” এই ধরণের বাক্যে যুগে
যুগে অজস্র প্রতিভা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়েছে।
এই ধরণের বৈষম্যের প্রতিকারের নানা নীতির মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে
প্রত্যক্ষ আইনি ব্যবস্থা, সামাজিক-অবস্থান ভিত্তিক বিশেষ আর্থিক সাহায্য (যেমন,
মেয়েদের জন্যে বিশেষ বৃত্তি), এবং সংরক্ষণ পড়ে, যদিও এদের নির্দিষ্ট রূপ এবং
আপেক্ষিক গুণাগুণ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, যা এই আলোচনার পরিধির বাইরে। খেয়াল করে
দেখুন যে এই ক্ষেত্রেও রল্সের যুক্তিটা
প্রযোজ্য – আপনার সামাজিক পরিচিতি কি হবে আপনি যদি না জানেন, তাহলে নিশ্চয়ই আপনি
বৈষম্য-বিরোধী নীতি সমর্থন করবেন।
তৃতীয়ত, এবার আসি আরেক স্তরের জটিলতায়। ধরা যাক ধনীদের সম্পদ অন্যায় উপায়ে আহৃত নয় এবং
যে ধরণের সুযোগের অসাম্য কথা এক্ষুনি আলোচনা
করলাম, তা প্রযোজ্য নয়। ধরা যাক একই পরিবারের মধ্যে দুই ভাই বা দুই বোনের কথা। ধরে
নেওয়া যাক ছোটবেলা থেকেই তাদের মধ্যে বাহ্যিক সুযোগের কোন ফারাক নেই। তাহলেও অনেক
সময়ই দেখা যাক তারা জীবনে সমানভাবে সফল হয়না (সে সাফল্যের যে মানদণ্ডই আমরা নিই,
অর্থ বা যশ বা সুখ )। এর জন্যে হয় দক্ষতা ও ব্যক্তিগত গুণাবলীর, বা পরিশ্রম ও উদ্যমের
ফারাক, বা নেহাতই ভাগ্যের ভূমিকা থাকে। এবার প্রশ্ন হল, এই ক্ষেত্রে যে তুলনায়
অসফল, তার প্রয়োজনে তাকে সাহায্য করার জন্যে তার পরিবারের বাড়তি কিছু করণীয়? পরিবারের
ক্ষেত্রে উত্তরটা সচরাচর হ্যাঁ, কারণ স্নেহ-মমতার স্বাভাবিক ধর্মেই সেখানে প্রয়োজন
এবং সাহায্যের মধ্যে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক আছে। এবার ধরে নেওয়া যাক যে সমাজেও কিছু
কিছু ক্ষেত্রে ধনী এবং গরীবের অসাম্যের সূত্র সুযোগের অসাম্য নয়, যোগ্যতার
ফারাকের, জীবনের নানা পদক্ষেপে নেওয়া কিছু ভুল সিদ্ধান্তের ফলের (যেমন, কুসঙ্গে
মিশে পড়াশুনো ছেড়ে দেওয়া, বা নেশার বশ হওয়া), বা নেহাতই দুর্ভাগ্যের (যেমন,
দুর্ঘটনা বা মন্দার কারণে চাকরি হারানো) প্রতিফলন। এখানে কি যে
পিছিয়ে পড়েছে তার প্রতি সমাজের কোন দায়িত্ব আছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার? রল্সের প্রস্তাবিত আঙ্গিকে ভাবলে এক্ষেত্রে যে বঞ্চিত তার জীবনযাত্রার
মান যেন ন্যূনতম একটা স্তরের তলায় না চলে যায়, তার ব্যবস্থা করা উচিত। তার কারণ হল এই প্রস্তাবিত নীতি একটা বীমার প্রকল্পের
মত, যা একটু আগে আলোচনা করেছি। বীমার প্রকল্পের ধর্মই হল, শুরুতে সবাই একই
পরিস্থিতিতে থাকে, এবং সমান হারে কিস্তি দেয়, কিন্তু তারপর যার প্রয়োজন (অসুখ বা
দুর্ঘটনার কারণে) সে সেই অনুযায়ী সাহায্যলাভ করে। লক্ষ্য করে দেখুন যে এই যুক্তির
সাথে সুযোগের সাম্য তৈরি করার কোন সম্পর্ক নেই । আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের
স্বপক্ষে এই “সামাজিক বীমার” যুক্তিটি অনেক সময় ব্যবহার করা হয়।
প্রবন্ধের প্রথম
অংশের তুলনায় এখানে অসাম্যের উদাহরণ গুলো এমন, যে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই পুনর্বণ্টনের সমর্থনে যুক্তি আছে। যদি অসাম্যের উৎস হয় অন্যায় শোষণ
তাহলে পুনর্বণ্টনের পক্ষে যুক্তি হল ন্যায়ের যুক্তি।
ফলাফলের অসাম্যের উৎস যদি হয় আর্থিক সুযোগের অসাম্য, বা প্রত্যক্ষ সামাজিক বৈষম্য তাহলে
পুনর্বণ্টনের স্বপক্ষে যুক্তি হল, সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করার। মনে রাখা ভালো,
আগের অংশে আমরা এমন কিছু উদাহরণ দেখেছি, যাতে সুযোগের অসাম্য থাকলেও (যেমন
মা-বাবার শিক্ষা বা ব্যক্তিগত গুণাবলী) তার প্রতিকারের জন্যে কোন নির্দিষ্ট নীতির কথা
ভাবা মুশকিল। আর অসাম্যের উৎস যদি সুযোগ-সম্পর্কিত
নাও হয় (যেমন, ভুল সিদ্ধান্ত, দুর্ভাগ্য) তাহলেও সবার জীবনযাত্রার মান যেন ন্যূনতম
একটা স্তরের নিচে না চলে যায়, পুনর্বণ্টনের স্বপক্ষে এই ধরণের সামাজিক বীমার একটা
যুক্তি আছে।
এখন অবধি আমরা অসাম্যের পক্ষের এবং বিপক্ষের যুক্তিগুলো আলোচনা করলাম। কিন্তু
এগুলো যোগ-বিয়োগ করে কি সিদ্ধান্তে আসব?
মূল লড়াইটার একদিকে
সুযোগের অসাম্য এবং ভাগ্য-তাড়িত চরম অনটনের প্রতিকার আর অন্যদিকে অর্থনৈতিক
দক্ষতাহ্রাসের সম্ভাবনা। আমরা যেহেতু রল্সের পদ্ধতি ব্যবহার করছি, অসাম্যের পক্ষে অন্য যে যুক্তি, মেধাতন্ত্র এবং
ব্যক্তিস্বাধীনতায় অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ, সেখানে অতটা জোর দিচ্ছিনা। কারণ, যে নীতি
অবলম্বন করা হবে, তা আমরা আমাদের ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে সরে গিয়ে একটা নিরপেক্ষ
অবস্থান থেকে করছি। তাই মেধাতন্ত্রের কথা মাথায় রেখেই আমরা সুযোগের অসাম্যের
প্রতিকার করছি। আর, যেহেতু এই নীতি নির্ধারিত হচ্ছে স্বেচ্ছায়, আমাদের এই নিরপেক্ষ
সত্ত্বার দিক থেকে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হচ্ছেনা। সেই রকম, অসাম্যের
বিপক্ষে যে যুক্তি এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে তাতে অন্যায় শোষণের সম্ভাবনা থাকবেনা,
কারণ আমরা স্বেচ্ছায় নিরপেক্ষ ভাবে এরকম ব্যবস্থার কখনই সমর্থন করবনা, কারণ
অজ্ঞানতার কুয়াশা সরে বাস্তবের রোদ উঠলে আমরা নিজেরাই শোষিতের দলে পড়ে যেতে
পারি।
সুযোগের অসাম্য এবং
ভাগ্য-তাড়িত চরম অনটনের প্রতিকার আর অর্থনৈতিক দক্ষতাহ্রাসের যে দ্বন্দ্ব তা আমরা
কিভাবে নিষ্পত্তি করব? উত্তরটা কি মাঝামাঝি রফা? অর্থাৎ, বেশি অসাম্য ভালোনা, আবার
বেশি সাম্যও ভালোনা - যাকে বাংলাভাষায় “মিউচুয়াল” করে নেওয়া বলা হয়। তা করব্যবস্থার মাধ্যমে না হয় আয়ের অসাম্য খানিক কমানো গেল, অতি-উদারবাদীরা ন্যূনতম
প্রশাসনের খরচ মেটাতে যতটাতে খুশি হবেন, সুযোগের সাম্য এবং সামাজিক সুরক্ষাজালের
কথা ভেবে তার থেকে নয় বেশিই পুনর্বণ্টন করা হবে ঠিক হল। কিন্তু
প্রশ্নটা হল প্রয়োজনের কোন মাপকাঠি ব্যবহার করে পুনর্বণ্টনের
প্রস্তাব রূপায়িত হবে ?
রল্সের মত হল, দুজন মানুষের মধ্যে
সুযোগের তুলনা করার প্রধান মাপকাঠি হল, কিছু সর্বপ্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর তাদের
অধিকার। আমাদের নানা জনের নানারকমের পছন্দ
এবং বয়সের সাথে সাথে সেগুলো পাল্টাতেও থাকে। হয়ত আমরা কেউ অর্থ, কেউ যশ,
কেউ সুখ চাইব। তাই আদি অবস্থানের কুয়াশাময় প্লাটফর্মে বসে জীবনে কি চাই,
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুশকিল। ভুতের রাজা যদি বর দিতে চান, তাহলে খুব নির্দিষ্ট
কিছু চাইলে মুশকিল, পরে আক্ষেপ হতে পারে। রল্স্ এখানেও
একটা ভালো বুদ্ধি বার করেছেন, সেটা হল প্রাথমিক পণ্যের (primary goods) ধারণা
। আমরা জীবনে কি করব না জানলেও, প্রতি পদে
যা চাইতে পারি তা পাবার সর্বোচ্চ সম্ভাবনা যা যা থাকলে হবে, তাই হল প্রাথমিক পণ্য।
অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠনের আড়ালে বসে আমরা সবাই তাই একমত হতে পারি, প্রাথমিক পণ্য আমাদের কতটা আয়ত্তে সেটাই আমাদের
জীবনে সুখ এবং সাফল্যের (তার নির্দিষ্ট রূপ যাই হোকনা কেন) সব চেয়ে বড়
নির্ধারক। এর মধ্যে যেমন মৌলিক কিছু
অধিকার আছে (যেমন রাজনৈতিক, ধর্মপালন ও মতপ্রকাশের অধিকার), সেরকম সুযোগের দরজা
(যেমন, বিভিন্ন পেশায় যোগ দেবার পথ) খোলা থাকার কথা বলা আছে, আয় ও ধনের অধিকারও আছে,
এবং আত্মসম্মানের সাথে সমাজে বাস করার অধিকারও আছে। ভুতের রাজার বর
সত্যি যারা পেয়েছিল, সেই গুপি আর বাঘা কি চেয়েছিল এই প্রসঙ্গে তার উল্লেখ করতেই
হয়। প্রথম বরে তারা ইচ্ছেমত পছন্দসই খাবার পাবার,
দ্বিতীয় বরে যেখানে খুশি নিমেষে যাবার, এবং তৃতীয় বরে, এমন সঙ্গীতপ্রতিভা আয়ত্ত করার
বর চেয়েছিল, যাতে তাদের গান শুনে লোকে সম্মোহিত হয়ে যাবে। এই তিনটেই প্রাথমিক পণ্যের ভালো উদাহরণ, বিশেষত
তিন নম্বর বরটির মধ্যে পছন্দসই পেশা এবং সামাজিক সম্মান দুটোই আছে।
লক্ষ্য করে দেখুন, প্রাথমিক পণ্যের ধারণার মধ্যেই যে চরম
দারিদ্র বা সামাজিক বৈষম্য বা মৌলিক কিছু অধিকারের অভাব যে ন্যায্য সমাজব্যবস্থার
ধারণার সাথে খাপ খায়না তা মেনে নেওয়া হচ্ছে। আমরা আগেই দেখেছি নৈতিক আপত্তি না
থাকলেও সাহস করে জাত বা লিঙ্গবৈষম্যের প্রস্তাবে কেউই একমত হবেন না – অজ্ঞানতার
অবগুণ্ঠন সরে গেলে যদি দেখতে পাওয়া যায় আপনারই কপালে জুটেছে বঞ্চিত গোষ্ঠীর
সদস্যপদ! তাই এই যুক্তি ব্যবহার করে আইনের চোখে সবার সমান অধিকারের প্রশ্নে একমত
হওয়া সোজা।
প্রাথমিক পণ্যের মধ্যে যেগুলো বস্তুগত (আয়, শিক্ষা,
স্বাস্থ্য ইত্যাদি) সেগুলো একটা ন্যূনতম মাত্রায় যাতে সবার আয়ত্ত থাকে, তার জন্যে
যে খরচ তা মেটাতে করব্যবস্থার মাধ্যমে আয় ও সম্পদের আংশিক পুনর্বণ্টন
প্রয়োজন। এখন এই পণ্যগুলো যোগান দেবার দায়িত্ব সরকার প্রতক্ষ্যভাবে নেবে (সরকারি
স্কুল, হাসপাতাল) না তার জন্যে অর্থসাহায্যের ব্যবস্থা করে সেগুলো যোগাড় করে নেবার
দায়িত্ব ব্যক্তি বা পরিবারের হাতে ছেড়ে দেবে, সেই প্রসঙ্গে এখানে ঢুকছিনা।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এই পুনর্বণ্টনের জন্যে যে সুযোগের
অসাম্যের অথবা চরম অনটনের আংশিক প্রতিকার হবে তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক দক্ষতা খানিকটা হ্রাস পাবে
(করের হার বেশি হলে ব্যক্তিগত উদ্যম খানিকটা খর্ব হবেই)। এই লাভক্ষতির হিসেব কি করে করা হবে? এর কোন নৈর্বক্তিক
উত্তর হয়না, তা আমাদের নৈতিক বিচারের ওপর নির্ভর করবে। রল্সের নিজস্ব মত হল, আদর্শ নীতি হল তাই, যা সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা
মানুষের সর্বোত্তম কল্যাণের কথা ভেবে নেওয়া। এই প্রসঙ্গে গান্ধীর বিখ্যাত উক্তি
মনে পড়ে যেতে বাধ্য - “যে কোন পদক্ষেপ নেবার আগে তোমার পরিচিত সবচেয়ে দরিদ্র এবং
দুর্বল মানুষের মুখটা ভাব এবং ভেবে দেখ এতে তার কোন উপকার হবে কিনা।”
এই বিষয়ে বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন মত থাকতে পারে। কেউ মনে করতে পারেন, যে সবচেয়ে
পিছিয়ে থাকা নয়, গড় নাগরিকের কল্যাণের ওপর জোর দেওয়া উচিত। বা কেউ এমনও মনে করতেই পারেন, সরকারের ন্যূনতম
দায়িত্ব পালনে যে খরচ তার বাইরে কোন রকম পুনর্বণ্টনের প্রয়োজন নেই। যিনি
ঝুঁকির
পরোয়া করেননা, তিনি জানেন যে তাঁর ভাগ্য ভালোও হতে পারে, আবার মন্দও
হতে পারে। কিন্তু এই ঝুঁকি নিতে তিনি
প্রস্তুত, বিশেষত পুনর্বণ্টনের ফলে যখন অর্থনৈতিক দক্ষতার ক্ষতি হতে পারে।
এখানে লক্ষণীয় এই যে, রল্সের নীতিকে আপাতদৃষ্টিতে খুবই সমতাপন্থী মনে
হলেও, এই ক্ষেত্রেও কিন্তু আয়ের ও সম্পদের খানিকটা অসাম্য মেনে নেওয়া হচ্ছে। তার
কারণ, আয় বা সম্পদ সর্বদা সম্পূর্ণ সমান হবে এরকম নীতি অবলম্বন করলে, অর্থনৈতিক দক্ষতাহ্রাসের সম্ভাবনা এতটাই হবে, যে তাতে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মানুষেরও
কল্যাণ হবেনা। উদাহরণ হিসেবে ভাবা যেতে
পারে বৈষয়িক প্রণোদনের অভাবে উদ্যম যদি তলানিতে গিয়ে ঠেকে, তাহলে দেশের গড় আয় এতটা
কমে যাবে, যে কর ব্যবস্থার মাধ্যমে পুনর্বণ্টন করে সবচেয়ে
দরিদ্রদের সাহায্য করার সামর্থ্যও কমে যাবে।
তার মানে, খানিকটা অসাম্য অনিবার্য।
এখন অবধি অসাম্যের পক্ষে এবং বিপক্ষে যত যুক্তিই আমরা দেখলাম, তাতে সমস্যাটা
আপাতদৃষ্টিতে বঞ্চনা বা দারিদ্রের, অসাম্যের নয়। রল্সের প্রস্তাবিত নৈতিক কাঠামোরও মূল উদ্দেশ্য বঞ্চনা বা
দারিদ্রের মোকাবিলা করা, এবং তার জন্যে যেটুকু অসাম্য হ্রাস করা প্রয়োজন, ততটাই। এখন
ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান কি হওয়া উচিত, তা স্থান ও কালের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু
কোন বিশেষ স্থান ও কালে, রল্স্ যে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মানুষের জীবনযাত্রার মান সর্বাধিক
সম্ভব মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যর কথা বলছেন, সেখানে জীবনযাত্রার মানের ধারণাটা
আপেক্ষিক (relative) নয়, অনাপেক্ষিক (absolute) ভাবা যেতেই পারে। তবে এই নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। কেউ আবার
মনে করতেই পারেন যে জীবনযাত্রার মানের ধারণাটাই একধরণের আকাঙ্ক্ষা (aspiration)
থেকে তৈরি হয় এবং তাতে সমাজে স্বচ্ছল মানুষের জীবনযাত্রার মানের একটা প্রভাব থাকে।
এইভাবে ভাবলে দারিদ্র বা বঞ্চনার একটা
আপেক্ষিক দিক আছে, এবং এই ক্ষেত্রে অসাম্য নিয়েও ভাবতে হবে, কারণ সমাজ যত অসম হবে,
তাতে এই আপেক্ষিক চাওয়া বাড়বে, এবং তার অভাবে জীবনযাত্রার মান বাড়াবার এক ইঁদুর
দৌড়ে সবাই সামিল হয়ে যাবার সম্ভাবনা হবে, যাতে আখেরে সবারই ক্ষতি হতে পারে।
পরের কিস্তির লিংক: http://maitreesh.blogspot.com/2014/10/blog-post.html
No comments:
Post a Comment