আগের পোস্টের লিংক: http://maitreesh.blogspot.com/2014/09/blog-post_23.html
আমরা অসাম্য বা বঞ্চনা নিয়ে এতক্ষণ যে আলোচনা করলাম, তা প্রধানত নৈতিক (normative) দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। সারা লেখাটায় “উচিত” শব্দটি কতবার ব্যবহার হয়েছে তার থেকেই তা বোঝা যাবে! এখানে প্রশ্নটা ন্যায্য-অন্যায্যের, কি কারণে অসাম্য বা বঞ্চনা বিভিন্ন অর্থব্যবস্থায় সৃষ্টি হয় তা নয়। সেইরকম অসাম্যের প্রতিকারের ক্ষেত্রেও আমাদের অবস্থানটা কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল । তার জন্যে রল্সের প্রস্তাবিত নিরপেক্ষ একটা দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ব্যাপারটা আমরা দেখলাম। রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে কি ভাবে এই অসাম্যের প্রতিকারের নীতি বাস্তবে অবলম্বন করা হয়, সে ব্যাপারে আমরা কিছু বলিনি। কেউ বলতেই পারেন, ধরে নেওয়া হচ্ছে অজ্ঞানতার কুয়াশা সরে বাস্তবের রোদ উঠলে অজ্ঞানতার অন্ধকারে যে নীতি নির্বাচিত হবে, তা নিখুঁতভাবে রূপায়িত হবে। কিন্তু তার জন্যে যে প্রতিষ্ঠান (institutions) গুলো দায়ি, তারা তো রল্সের এই কাল্পনিক পরিকল্পনা কমিশনের মত লোভ-ভ্রষ্টাচার-পক্ষপাত-অন্যায়ের উর্ধে নয়। বাজারই হোক বা প্রশাসন, সরকারই হোক বা আইনব্যবস্থা, ক্ষমতাশালীদের প্রভাব থেকে কেউ মুক্ত নয়। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই । আমেরিকায় আয়করের সর্বোচ্চ হার হল ৩৫% আর পুঁজির বিনিয়োগের থেকে আয়ের (capital earnings) ওপর সর্বোচ্চ করের হার হল ১৫% । তাই, আদতে এই কর ব্যবস্থা প্রগতিশীল নয়, তার উল্টো। এই নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের একজন, ওয়ারেন বাফেট লিখেছেন যে তাঁর মত আয়ের ওপর করের যে আনুপাতিক হার তা তাঁর সব কর্মচারীদের থেকে অনেক কম, কারণ তাঁর মোট আয়ের প্রায় সবটাই পুঁজির বিনিয়োগের থেকে। এর কারণ খুব সোজা। আইনি ও বেআইনি অনেক পথে ধনীদের রাজনৈতিক প্রভাব মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের থেকে অনেক বেশি। তাই গণতন্ত্রে প্রত্যেক মানুষের একটা করে ভোট থাকলেও, মানুষে মানুষে অনেক ফারাক আছে, সব মানুষ নয়কো সমান।
আমরা অসাম্য বা বঞ্চনা নিয়ে এতক্ষণ যে আলোচনা করলাম, তা প্রধানত নৈতিক (normative) দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। সারা লেখাটায় “উচিত” শব্দটি কতবার ব্যবহার হয়েছে তার থেকেই তা বোঝা যাবে! এখানে প্রশ্নটা ন্যায্য-অন্যায্যের, কি কারণে অসাম্য বা বঞ্চনা বিভিন্ন অর্থব্যবস্থায় সৃষ্টি হয় তা নয়। সেইরকম অসাম্যের প্রতিকারের ক্ষেত্রেও আমাদের অবস্থানটা কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল । তার জন্যে রল্সের প্রস্তাবিত নিরপেক্ষ একটা দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ব্যাপারটা আমরা দেখলাম। রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে কি ভাবে এই অসাম্যের প্রতিকারের নীতি বাস্তবে অবলম্বন করা হয়, সে ব্যাপারে আমরা কিছু বলিনি। কেউ বলতেই পারেন, ধরে নেওয়া হচ্ছে অজ্ঞানতার কুয়াশা সরে বাস্তবের রোদ উঠলে অজ্ঞানতার অন্ধকারে যে নীতি নির্বাচিত হবে, তা নিখুঁতভাবে রূপায়িত হবে। কিন্তু তার জন্যে যে প্রতিষ্ঠান (institutions) গুলো দায়ি, তারা তো রল্সের এই কাল্পনিক পরিকল্পনা কমিশনের মত লোভ-ভ্রষ্টাচার-পক্ষপাত-অন্যায়ের উর্ধে নয়। বাজারই হোক বা প্রশাসন, সরকারই হোক বা আইনব্যবস্থা, ক্ষমতাশালীদের প্রভাব থেকে কেউ মুক্ত নয়। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই । আমেরিকায় আয়করের সর্বোচ্চ হার হল ৩৫% আর পুঁজির বিনিয়োগের থেকে আয়ের (capital earnings) ওপর সর্বোচ্চ করের হার হল ১৫% । তাই, আদতে এই কর ব্যবস্থা প্রগতিশীল নয়, তার উল্টো। এই নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের একজন, ওয়ারেন বাফেট লিখেছেন যে তাঁর মত আয়ের ওপর করের যে আনুপাতিক হার তা তাঁর সব কর্মচারীদের থেকে অনেক কম, কারণ তাঁর মোট আয়ের প্রায় সবটাই পুঁজির বিনিয়োগের থেকে। এর কারণ খুব সোজা। আইনি ও বেআইনি অনেক পথে ধনীদের রাজনৈতিক প্রভাব মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের থেকে অনেক বেশি। তাই গণতন্ত্রে প্রত্যেক মানুষের একটা করে ভোট থাকলেও, মানুষে মানুষে অনেক ফারাক আছে, সব মানুষ নয়কো সমান।
এই সমস্যাটা শুধু রল্সের ক্ষেত্রে
প্রযোজ্য নয়। মার্ক্স তাঁর আদর্শ সমাজের বর্ণনা করেছিলেন এমন এক ব্যবস্থা যেখানে
প্রত্যেকে তার ক্ষমতা অনুযায়ী দেবে, আর প্রয়োজন অনুযায়ী নেবে। এখানেও, এটা একটা
নৈতিক বা আদর্শ অবস্থান। পরিবারের মধ্যে এইরকম একটা নীতির কথা ভাবাই যেতে পারে।
গোটা সমাজ নিয়ে এই ভাবে ভাবা যেতে পারে কি না, সেটা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু সে কথা
বাদ দিয়েও, সমাজতন্ত্রের যে চেহারা পূর্ব ইয়োরোপ বা চিনে আমরা দেখেছি, তার সাথে এই
আদর্শের মিল খুব অল্প। সেখানেও, বাস্তবে নীতির যাদের হাতে রূপায়িত হত, তারা ক্ষমতা হাতে পেয়ে এই আদর্শের থেকে অনেক
দূরে সরে গেছিল, ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাহীনদের মধ্যে নতুন শ্রেণী বিভাজনের পত্তন
হয়েছিল।
তার মানে কি এই
আদর্শ নীতির আলোচনার কোন মূল্য নেই? আছে এই কারণে, যে এগুলো আমাদের
একটা মানদণ্ড দেয় যা দিয়ে আমরা বাস্তবের হাজারো সমস্যাদীর্ণ বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে যা
হতে দেখি তার মূল্যায়ন করতে পারি, বিভিন্ন প্রস্তাবিত নীতির মধ্যে তুলনামূলক বিচার
করতে পারি। বাস্তব পৃথিবীর এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দিয়ে চলার পথে যেমন মানচিত্রের
প্রয়োজন হয় যেখানে পথঘাট সোজা, সরল, এবং নিখুঁত, বা অসুস্থ রোগীকে সারিয়ে তুলতে
সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের শরীরের ক্রিয়াপ্রক্রিয়া বোঝার দরকার হয়, এক্ষেত্রে আদর্শ
নীতি আলোচনার প্রয়োজনও অনেকটা একই রকম। আদর্শ
পরিস্থিতির মধ্যে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে অসাম্যের দিকে দেখলে তার কতটা অধরা, কতটা
অসহনীয়, আর কতটা অনিবার্য না বুঝতে পারলে তার সম্ভাব্য প্রতিকারের পথ খুঁজে পাওয়া
যাবে কি করে?
একটা কথা বলে শেষ করি। অসাম্যের ভাল-মন্দ বিচারে আমরা
দেখেছি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমস্যাটা অসাম্য নয়, বঞ্চনা বা দারিদ্র নিয়ে। কিন্তু
বাস্তব পৃথিবীতে অসাম্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ আছে। আর্থিক অসাম্য থেকে তৈরি হয়
ক্ষমতা বা প্রভাবের অসাম্য। আর ক্ষমতার অসাম্য যত বাড়ে, আদর্শ নীতি আর বাস্তবে যে
নীতি অবলম্বন করা হয় এবং রূপায়িত করা হয়, তাদের মধ্যে ফারাকও তত বাড়ে। এই ক্ষেত্রে
সমস্যাটা শুধু দারিদ্র বা বঞ্চনার নয়, অসাম্যেরও।
তবে ধনতন্ত্রে ক্ষমতা আর আর্থিক স্বচ্ছলতার মধ্যে
যেরকম সম্পর্ক, অন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থের জায়গায় সেটা অন্যকিছুর অধিকার বা
মালিকানা হয়। যেমন, সামন্ততন্ত্রে জমির
মালিকানা এবং বংশানুক্রমিকভাবে প্রাপ্ত মর্যাদা ও বিশেষাধিকার হল ক্ষমতার উৎস। তাই আয় ও সম্পদের অসাম্য নিয়ে দুশ্চিন্তা করার জোরদার
কারণ একটা আছে। টমাস পিকেটির সাম্প্রতিক বইয়ে আয় ও ধনের ক্রমবৃদ্ধিমান অসাম্য নিয়ে
অনেক গুরুত্বপূর্ণ নতুন তথ্য এবং অস্বস্তিকর কিছু প্রশ্ন আছে। কিন্তু
এখানেও প্রশ্ন হল, প্রতিকারের উপায় কি - করের হার বৃদ্ধি না কি অর্থনৈতিক ও
রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গুলোর সংস্কার যাতে সরকারি নীতির ওপর ধনীদের প্রভাব হ্রাস
পায়, না কি দুটোই ? না কি এই সমস্যাগুলোর প্রতিকার নেই, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার
এগুলো অবশ্যম্ভাবী উপসর্গ ? এই সব প্রশ্ন
নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এই প্রবন্ধের পরিধির বাইরে। কিন্তু তাদের গুরুত্ত্ব অস্বীকার করা যায়না । আমাদের প্রতিদিনের জীবনে, অর্থনীতি বা রাজনীতি সব
ক্ষেত্রেই ক্ষমতার অসাম্যের বিষময় ফলের উদাহরণ আমাদের চারপাশে। খুব আদিম নানা
সংঘাত আমাদের চারপাশে অহরহ ঘটে চলে, যা মূলত জোরজবরদস্তি করে দরিদ্রের নামমাত্র সম্বল (তা জমিই হোক, বা প্রাকৃতিক সম্পদ) কবজা
করার জন্যে ধনীর অক্লান্ত প্রয়াস। আইন আছে, রাষ্ট্রব্যবস্থা আছে, রাজনৈতিক দল আছে, কিন্তু
এই সব ক্রীড়াঙ্গনও তো সমতল নয় – এখানেও সুযোগের অসাম্য প্রবল।
ক্ষমতার অসাম্যের সাথে আয় বা সম্পদের অসাম্যের
সম্পর্ক, এবং তার কার্যকারণ ও সম্ভাব্য প্রতিকার বোঝা অবশ্য প্রয়োজনীয়। তা নিয়ে
পরে কখনো বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছে রইল। কিন্তু প্রথমে বোঝা দরকার, আদর্শ
ব্যবস্থা আমাদের আয়ত্তে থাকলে আমরা কি চাইতাম। অর্থাৎ, ফিরে যেতে হবে জন্মের আগের
সেই কুয়াশাঘেরা প্ল্যাটফর্মে।
অনুষ্টুপ, শারদীয় সংখ্যা, ২০১৪ এ প্রকাশিত । সম্পূর্ণ লেখাটির লিঙ্ক : http://econ.lse.ac.uk/staff/mghatak/anushtup2014.pdf
No comments:
Post a Comment