Wednesday, September 3, 2014

অসহ অসাম্য

আগের পোস্টে (http://maitreesh.blogspot.com/2014/08/blog-post_31.html - আর একবার একটু চোখ বুলিয়ে নেবেন, কিছু ঘষা মাজা হয়েছে, আর সব চেয়ে বড় কথা, চন্দ্রবিন্দুর গানের কলি ঢোকানো হয়েছে!) দেওয়া উদাহরণগুলো নিয়ে বিশেষ থেকে একটু সাধারণে গিয়ে আলোচনা করা যাক।

প্রথমত, আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা কি অসাম্যের (inequality) না বঞ্চনার (deprivation) বিরুদ্ধে – কেউ অন্যদের থেকে ভালো করছে বা ভালো আছে সেটা সমস্যা, না কেউ অন্যদের থেকে খারাপ করছে বা খারাপ আছে সেটা নিয়েই আমাদের মাথাব্যথা ।  সবাই যদি ভালো থাকে কিন্তু কেউ কেউ ভীষণ ভালো থাকে তাহলে কি আমাদের কোন আপত্তি আছে, না কি “কার ঘরে প্রদীপ জ্বলেনি, কার বাঁচার অন্ন মেলেনি, কার নেই আশ্রয় বর্ষায়, দিন কাটে ভাগ্যের ভরসায়” তাকে সাহায্য করতে হবে, এটাই হল আমাদের মূল লক্ষ্য? 

দ্বিতীয়ত, সাম্য-অসাম্যের আলোচনা অধিকাংশ সময় আর্থিক সূচকের (আয়, সম্পদ, ব্যয়) মধ্যেই আবদ্ধ থাকি। কিন্তু জীবনযাত্রার মান অনেক উপাদানের ওপর নির্ভর করে, তার মধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সম্মান, নিরাপত্তা বোধ, নাগরিক অধিকার আছে, এবং ইদানীং অনেক সমীক্ষায় সুখ বা জীবনযাত্রার মান নিয়ে সার্বিক তৃপ্তিবোধের (life satisfaction) ওপরেও তথ্য আহরণ করা হয়। তাই সাম্য-অসাম্যের আলোচনায় এই সূচক গুলো নিয়ে মানুষে মানুষে যে বৈষম্য তা এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। আর এগুলোর ক্ষেত্রে অসাম্যই হোক আর বঞ্চনা, আয় বা আর্থিক সম্পদের ক্ষেত্রে পুনর্বণ্টনের মত সেগুলোর প্রতিকার করা আরও শক্ত। 

তৃতীয়ত, আমাদের ভাবতে হবে যে আমরা ফলাফলের অসাম্যের বিরুদ্ধে না সুযোগের অসাম্যের বিরুদ্ধে। এখানে একটা কথা পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। ফলাফল যদি শুধু পরিশ্রমের ওপর নির্ভর করে, তাহলে ফলাফলের অসাম্যের বিরুদ্ধে খুব একটা কিছু বলা মুশকিল। যে পরিশ্রম বেশি করেছে, তার আয় (বা যশ) বেশি হবে, এটা নিয়ে আপত্তি করার কোন যুক্তিসম্মত কারণ নেই।  সুযোগের অসাম্য থাকলে ব্যাপারটা আলাদা। এ ক্ষেত্রে ভেবে দেখতে হবে, একই সুযোগ পেয়ে (যেমন একই পরিবারে দুই ভাই বা বোন) যদি ফলাফল আলাদা হয়, সেটা নিয়ে আমাদের সমস্যা, না কি দুজন সমান সুযোগ পাচ্ছেনা এবং তাই প্রতিযোগিতার ময়দানটা অসম, এটাই আমাদের বিচলিত করে?

আবার আরেক গুচ্ছ প্রশ্ন, তবে আমার নয়, কবি সুকান্তর :

বলতে পার বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে?
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?
বড়মানুষ ভোজের পাতে ফেলে লুচি-মিষ্টি
গরীবরা পায় খোলামকুচি, একই অনাসৃষ্টি?
বলতে পারো ধনীর বাড়ি তৈরি যারা করছে
কুঁড়েঘরেই তারা কেন মাছির মত মরছে?
ধনীর মেয়ের দামী পুতুল হরেক রকম খেলনা,
গরীব মেয়ে পায় না আদর, সবার কাছে ফেলনা।
বলতে পারো ধনীর মুখে যারা যোগায় খাদ্য
ধনীর পায়ের তলায় তারা থাকতে কেন বাধ্য?

সুকান্ত আমাদের কাছে অসাম্যের এই বিভিন্ন উদাহরণগুলো সহনীয় কিনা জিজ্ঞাসা করছেননা। ধরেই নেওয়া হচ্ছে তার উত্তর হল না। উনি যে আঙ্গিকে প্রশ্নগুলো করেছেন, তার উদ্দেশ্য এটাই দেখান, যে এর কোন গ্রহণযোগ্য উত্তর নেই। তাই যে ব্যবস্থা এই অসাম্য সৃষ্টি করে, প্রশ্নগুলো তার অন্যায্যতার প্রতি তোলা অভিযোগের আঙ্গুল। যে অসাম্যের ছবি এই ছড়াটিতে প্রায় সত্তর বছর আগে কবি এঁকেছেন, তার শৈলী এবং প্রাসঙ্গিকতা এমনই যে আজও তা আমাদের ক্ষুব্ধ করে, আমাদের ন্যায়বোধে কশাঘাত করে, এবং জাগিয়ে তোলে এর প্রতিকার করার ইচ্ছে।
একটু তলিয়ে ভেবে দেখা যাক কেন এইধরণের অসাম্যের আমরা বিরোধী।

প্রত্যেকটা উদাহরণে ধনী ও গরীবের মধ্যে বিত্ত ছাড়া আর কিছুর ফারাক নেই। যেমন, ধরে নেওয়া যায়, এই বিত্ত অর্জনের জন্যে কোন প্রতিভা বা পরিশ্রম বা সঞ্চয়ী মনোভাবের দিক থেকে কোন পার্থক্য নেই। ধন এখানে হয় সম্পূর্ণ ভাগ্যনির্ধারিত আর তা না হলে অন্যায় উপায়ে, শোষণের মাধ্যমে পুঞ্জীভুত এক বিশেষাধিকার (privilege) যা কোন অর্থেই প্রাপ্য বা অর্জিত নয়। তুলনায় একজন দরিদ্র মানুষকে বেঁচে থাকার জন্যে অসহনীয় পরিশ্রম করতে হয় । তার আয়টা ন্যায্য পথে অর্জিত, কিন্তু পরিশ্রম এবং ফলের মধ্যে সমীকরণটা নেহাতই অন্যায্য ।  কবি নিজেই এই কবিতার শেষ দুই পঙক্তিতে তাঁর করা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন : 

‘হিং-টিং-ছট’ প্রশ্ন এসব, মাথার মধ্যে কামড়ায়,
বড়লোকের ঢাক তৈরি গরীব লোকের চামড়ায় ।।

অর্থাৎ, ধনীর ধন গরীবের রক্ত শুষেই তৈরি হয় । তার আগের পঙক্তিগুলোতে ছিল ধনী ও গরীবের জীবনযাত্রার বিসদৃশ বৈষম্যের কথা, কিন্তু এই বৈষম্য কি ভাবে তৈরি হচ্ছে সেই প্রশ্নের উত্তর ছিলনা। কবির উত্তর হল, একটি আরেকটির প্রত্যক্ষ কারণ।  ধনীর যে বিত্ত তাতে তার কোন বৈধ অধিকার নেই, কারণ তা অন্যায় উপায়ে অর্জিত। চোর বা ডাকাত অসৎপথে পাওয়া সম্পদের অধিকার জাহির করলে তা যেমন হাস্যকর হবে, এখানেও তাই। এর আগে খেলার যে উদাহরণ ব্যাবহার করেছিলাম, তার সূত্র টেনে বলা যায়, এখানে খেলাটা ময়দানের ভাষায় পুরো গট-আপ।
 

এর আগে আমরা দেখেছি কোন কোন ক্ষেত্রে অসাম্য হয় অধরা নয়তো অনিবার্য । এখানে দেখছি তার উলটো । অর্থাৎ, সব অসাম্য নয় সমান।

পরের কিস্তির লিংক:
http://maitreesh.blogspot.com/2014/09/blog-post_9.html 




 

 

No comments:

Post a Comment