পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ও বামফ্রন্টের কৃষিনীতি -- একটি পর্যালোচনা
মৈত্রীশ ঘটক
১
ষাটের দশকের শুরু থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের পরিসংখ্যানের ধারাবাহিক এবং তুলনাযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। তখন থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত সারা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি একটা ছবি যদি দেখি, তাতে দুটো প্রবণতা চোখে পড়তে বাধ্য।
প্রথমত, মাথাপিছু গড় আয়ের দিক থেকে ষাটের দশকে সমস্ত রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ একদম প্রথম সারিতে ছিল, তার পর তার আপেক্ষিক অবস্থার ক্রমাবনতি হয়েছে, যে প্রবণতা গত এক দশকে অব্যাহত আছে। জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম পনেরটি রাজ্যের মধ্যে ষাটের দশকের গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল একদম ওপরে, তামিলনাড়ুর ঠিক পরেই (এবং তাদের মধ্যে তফাৎ ছিল নেহাতই সামান্য), তার পরে ছিল মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, গুজরাট ইত্যাদি। ষাটের দশকের শেষ থেকেই পিছিয়ে পড়া শুরু হয়। ষাটের দশকে গড় হিসেবে করলে রাজ্যের তালিকায় মাথাপিছু গড় আয়ে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান ছিল তিন, সত্তরের দশকে তা নেমে হয় ছয়, আশি ও নব্বইয়ের দশকে তা হয়ে দাঁড়ায় সাত ও আট। গত এক দশকে তা দাঁড়িয়েছে এগারোয়।
বৃদ্ধির হারও একই কথা বলে (সারণী ১ দ্রষ্টব্য)। যখন রাজ্যের অবস্থান ওপরের দিকে ছিল, তখন দেশের তুলনায় বৃদ্ধির হার কম হওয়ায় আপেক্ষিক অবস্থানে অধোগতি শুরু হয়। কিন্তু বৃদ্ধির হারের সাথে মাথাপিছু গড় আয়ের সম্পর্ক বিপরীতমুখী - ঠিক যেমন পরীক্ষার নম্বর আর সেই নম্বরের বৃদ্ধির হারের মধ্যে সম্পর্ক। যখন নম্বর বেশি, তখন আরো বেশি নম্বর তোলা মুশকিল, কিন্তু নম্বর অল্প হলে উন্নতি বা বৃদ্ধির হার বেশি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেরকম একবার পিছিয়ে পড়লে বৃদ্ধির হার ভালো হওয়া খুব শক্ত নয়, কিন্তু আগের জায়গা ফিরে পাওয়া অনেক বেশি শক্ত।
সারণী ১: পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের গড় মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধির হার
বছর |
মাথাপিছু আয়ের গড় বৃদ্ধির হার |
|
পশ্চিমবঙ্গ |
ভারত |
|
১৯৬১-১৯৭১ |
-0.২% |
১.৭% |
১৯৭১-১৯৮১ |
১.১% |
0.৭% |
১৯৮১-১৯৯১ |
২.0% |
৩.৪% |
১৯৯১-২০০১ |
৪.৭% |
৩.৫% |
২০০১-২০১১ |
৫.১% |
৪.৯% |
২০১১-২০২০ |
৩.৮% |
৪.৮% |
১৯৬১-২০২০ |
২.৮% |
৩.১% |
দ্বিতীয়ত, রাজ্যের আয়ে যদি কৃষি, শিল্প এবং পরিষেবার অনুপাত দেখি (সারণী ২), তাহলে যেটা উল্লেখযোগ্য তা হলো ষাটের দশকের পরের তিন দশকে সারা ভারতে কৃষির আপেক্ষিক গুরুত্ব কমেছে, কিন্তু রাজ্যে কৃষির আপেক্ষিক গুরুত্ব কমেনি। বিভিন্ন দেশ ও কাল জুড়ে উন্নয়নের প্রক্রিয়ার একটা পরিচিত ছবি হলো কৃষির আপেক্ষিক গুরুত্ব কমা, এবং তার জায়গায় প্রথমে শিল্প ও তারপরের পরিষেবার আপেক্ষিক গুরুত্ব বাড়া। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের একটা বড়ো সময় জুড়ে এই প্রবণতা খানিকটা পরিচিত ছকভাঙা।
সারণী ২: পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতে মোট উৎপাদনে বিভিন্ন ক্ষেত্রের অবদান
বছর |
কৃষি ও সম্পর্কিত ক্ষেত্র |
শিল্প |
পরিষেবা |
|||
পশ্চিমবঙ্গ |
ভারত |
পশ্চিমবঙ্গ |
ভারত |
পশ্চিমবঙ্গ |
ভারত |
|
১৯৬১-১৯৭১ |
৪০.১% |
৫৩.১% |
৩৪.০% |
২১.৬% |
২৫.৯% |
২৫.৪% |
১৯৭১-১৯৮১ |
৪১.২% |
৪৮.১% |
৩১.২% |
২৪.৭% |
২৭.৬% |
২৭.২% |
১৯৮১-১৯৯১ |
৪২.৭% |
৪১.৬% |
২৬.৯% |
২৭.২% |
৩০.৪% |
৩১.৩% |
১৯৯১-২০০১ |
৪০.৯% |
৩৩.৭% |
২৫.৫% |
৩০.১% |
৩৩.৬% |
৩৬.২% |
২০০১-২০১১ |
৩০.৪% |
২৪.৪% |
২৭.৮% |
৩১.৮% |
৪১.৮% |
৪৩.৮% |
২০১১-২০২০ |
২২.৮% |
১৭.৮% |
২৬.০% |
৩১.৫% |
৫১.২% |
৫০.৭% |
১৯৬১-২০২০ |
৩৬.৩% |
৩৬.৫% |
২৮.৬% |
২৭.৮% |
৩৫.১% |
৩৫.৮% |
টিকা: বিভিন্ন ক্ষেত্রের অবদান বাৎসরিক ভিত্তিতে গণনা করা হয়েছে, এবং তারপর সারা দশকের গড় নেওয়া হয়েছে। রাজ্যের নীট দেশজ উৎপাদন (net state domestic product) ২০১১-১২ সালের মূল্যের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে, দেশের ক্ষেত্রে সমস্ত রাজ্যের মোট নীট দেশজ উৎপাদন হিসেবে করে গড় নেওয়া হয়েছে ।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে শিল্প ও কৃষির আপেক্ষিক অনুপাতের এই ভিন্নতর চিত্রের কারণ কী? এর একটা উত্তর অবশ্যই শিল্পক্ষেত্রে রাজ্যের পিছিয়ে পড়া। ষাটের দশক থেকে শুরু করে উদারীকরণে নীতি চালু হবার সময় অবধি রাজ্যে শিল্পক্ষেত্রের বৃদ্ধির হার সারা দেশের থেকে লক্ষণীয়ভাবে কম ছিল। উদারীকরণের পরের তিন দশকে রাজ্যে এবং দেশে দু' জায়গাতেই শিল্পে বৃদ্ধির হার বাড়ে, কিন্তু দেশের তুলনায় রাজ্যের বৃদ্ধির হার অল্প হলেও কম থেকে যাওয়ায়, তার আগের তিন দশকে হারানো জমি উদ্ধার করা যায়নি। এর সমস্ত দায় রাজ্যের নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু নীতিও (যেমন, মাসুল সমীকরণ) অবশ্যই দায়ী। রাজ্যের শিল্পক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার কার্যকারণ এই প্রবন্ধের আলোচনার বিষয় নয় - তা আলাদা বিশ্লেষণ দাবি করে। কিন্তু যে সময় ধরে রাজ্যে শিল্পের অবনতি হয়েছে, তার পাশাপাশি কৃষিতে রাজ্যে সারা দেশের তুলনায় আপেক্ষিক সাফল্য না দেখলে ছবিটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সত্তর, আশি, ও নব্বইয়ের দশকে রাজ্যে কৃষি উৎপাদোনের হার সারা দেশের গড় বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি ছিল (সারণী ৩ দ্রষ্টব্য)।
সারণী ৩: পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতে বিভিন্ন ক্ষেত্রের উৎপাদনের বৃদ্ধির হার
বছর |
কৃষি ও সম্পর্কিত ক্ষেত্র |
শিল্প |
পরিষেবা |
|||
পশ্চিমবঙ্গ |
ভারত |
পশ্চিমবঙ্গ |
ভারত |
পশ্চিমবঙ্গ |
ভারত |
|
১৯৬১-১৯৭১ |
১.৮% |
৪.২% |
২.৬% |
৭.০% |
২.৭% |
৫.৩% |
১৯৭১-১৯৮১ |
৩.৫% |
১.৯% |
২.১% |
৪.৫% |
৪.০% |
৪.৬% |
১৯৮১-১৯৯১ |
৪.৩% |
৩.৫% |
৩.৩% |
৬.৩% |
৫.১% |
৬.৪% |
১৯৯১-২০০১ |
৪.৭% |
২.৭% |
৬.০% |
৫.৬% |
৮.২% |
৭.৬% |
২০০১-২০১১ |
২.২% |
৩.৯% |
৬.৫% |
৮.৭% |
৮.১% |
৯.৩% |
২০১২-২০১৯ |
২.৫% |
৩.৪% |
৭.২% |
৭.১% |
৫.৪% |
৭.৩% |
১৯৬১-২০১৯ |
৩.২% |
৩.২% |
৪.৬% |
৬.৬% |
৫.৬% |
৬.৮% |
টিকা: বাৎসরিক বৃদ্ধির হারের দশকব্যাপী গড় নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রের অবদান বাৎসরিক ভিত্তিতে গণনা করা হয়েছে, এবং তারপর সারা দশকের গড় নেওয়া হয়েছে। রাজ্যের নীট দেশজ উৎপাদন (net state domestic product) ২০১১-১২ সালের মূল্যের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে, দেশের ক্ষেত্রে সমস্ত রাজ্যের মোট নীট দেশজ উৎপাদন হিসেবে করে গড় নেওয়া হয়েছে । বাৎসরিক পরিসংখ্যানের তুলনার সমস্যার কারণে ২০১১-১২ সালকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের সাথে পরিবেশ ও ভৌগলিক দিক থেকে মিল থাকায় পশ্চিমবঙ্গের কৃষিক্ষেত্রের তুলনা করা যেতে পারে। তা যদি করি (সারণী ৪) তাহলে উল্লেখযোগ্য যে সত্তর, আসি ও নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধির হার বেশি ছিল।
সারণী ৪: পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, ও বাংলাদেশে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনের বৃদ্ধির হার
বছর |
কৃষি ও সম্পর্কিত ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার |
||
পশ্চিমবঙ্গ |
ভারত |
বাংলাদেশ |
|
১৯৬১-১৯৭১ |
১.৮% |
৪.২% |
৩.২% |
১৯৭১-১৯৮১ |
৩.৫% |
১.৯% |
|
১৯৮১-১৯৯১ |
৪.৩% |
৩.৫% |
|
১৯৯১-২০০১ |
৪.৭% |
২.৭% |
|
২০০১-২০১১ |
২.২% |
৩.৯% |
৪.২% |
২০১২-২০১৯ |
২.৫% |
৩.৪% |
৩.৩% |
১৯৬১-২০১৯ |
৩.২% |
৩.২% |
২.৭% |
শুধু উৎপাদন নয়, আমরা যদি উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির হারও দেখি, তাহলে আশি ও নব্বইয়ের দশকে রাজ্যের বৃদ্ধির হার সারা দেশের গড় বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি। অথচ আমরা যদি ধানচাষ বা খাদ্যশস্যের উৎপাদনশীলতার মানের স্তর দেখি, তা কিন্তু ষাটের দশকের গোড়া থেকে শুরু করে এখন অবধি দেশের গড় উৎপাদনশীলতার মানের থেকে বেশি। দেশের গড়ের থেকে এগিয়ে থেকেও রাজ্যে কৃষির উৎপাদনশীলতার দ্রুততর গতিতে বৃদ্ধি হয়েছে, এটা উল্লেখযোগ্য। যদি উল্টোটা হোত, অর্থাৎ পিছিয়ে থাকা অবস্থায় শুরু করে দ্রুততর গতিতে বৃদ্ধি হোত, তা হলে বলা যেত নেহাতই পিছিয়ে ছিল বলেই উন্নতির অবকাশ ছিল।
রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতিতে সত্তর, আশি, ও নব্বইয়ের দশকে উন্নয়নের প্রমাণ শুধু উৎপাদনশীলতাতেই নয়, অন্যান্য নানা মাপকাঠিতেও ধরা পড়েছে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার (ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে বা যেন এস এস) পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যে দারিদ্রসীমার নিচের গ্রামীণ জনসংখ্যা দেশের গড়ের তুলনায় অধিকতর হারে হ্রাস পেয়েছে (সারণী ৫) সত্তরের দশকের গোড়া থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষ অবধি।
সারণী ৫: দারিদ্ররেখার তলায় গ্রামীণ জনসংখ্যার অনুপাত
পশ্চিমবঙ্গ |
ভারত |
|
১৯৭৩-১৯৭৪ |
৭৩.২ |
৫৬.৪ |
১৯৭৭-১৯৭৮ |
৬৮.৩ |
৫৩.১ |
১৯৮৩-১৯৮৪ |
৬৩.১ |
৪৫.৬ |
১৯৮৭-১৯৮৮ |
৪৮.৩ |
৩৯.১ |
১৯৯৩-১৯৯৪ |
৪০.৮ |
৩৭.৩ |
১৯৯৯-২০০০ |
৩১.৯ |
২৭.১ |
২০০৪-২০০৫ |
২৮.৬ |
২৮.৩ |
তাই রাজ্যের অর্থনৈতিক যাত্রাপথে শিল্পের ক্ষেত্রে হতাশাজনক রেকর্ডের পাশাপাশি কৃষিতে আপেক্ষিক সাফল্য মনোযোগ দাবি করে।
২
পশ্চিমবঙ্গে কৃষিতে আপেক্ষিক সাফল্যের কারণ কী?
একটা মত হল আশি ও নব্বইয়ের দশকের পশ্চিমবঙ্গে কৃষির উৎপাদনশীলতা যেটুকু বেড়েছে তা
মূলত সবুজ বিপ্লবের বিলম্বিত আগমনের ফল (উচ্চফলনশীল বীজ বা সেচের প্রসার) যার মূলে
আছে ব্যক্তিগত উদ্যোগ। কিন্তু এই যুক্তির সমস্যা হল, এটি সারা পূর্বাঞ্চলের এবং
প্রতিবেশী বাংলাদেশের (যা আবহাওয়া, প্রকৃতি, কৃষিপ্রযুক্তি বা ভূমিব্যবস্থার দিক
দিয়ে অনেকটাই এই রাজ্যের সাথে তুলনীয়) ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ
করে দেখা যাচ্ছে যে ধান চাষে উচ্চফলনশীল বীজের প্রসার
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে তুলনীয় হারেই হয়েছিল। অথচ পশ্চিমবঙ্গে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা
বৃদ্ধির হার বাকি সারা ভারত এবং বাংলাদেশের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
কিছু
সমালোচক মনে করেন পশ্চিমবঙ্গে কৃষিতে উৎপাদনশীলতার এই অতিরিক্ত বৃদ্ধির হার
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে কৃষি পরিসংখ্যান নিয়ে কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে
পরিসংখ্যানগত অতিরঞ্জনের কারণে হতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে নতুন ও পুরনো সিরিজের
পরিসংখ্যান ব্যবহার করে এবং গণনার সময়সীমা এগিয়ে ও পিছিয়ে বিভিন্নভাবে বৃদ্ধির হার
গণনা করে এই বিতর্কের খানিকটা নিষ্পত্তি করা সম্ভব। আমরা সেটা করে দেখছি যে
১৯৭৭-এর পর থেকে আশির দশক এবং নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গে কৃষির উৎপাদনশীলতার
বৃদ্ধির হার তার আগের ও পরের পর্যায়ের তুলনায় বেশি। শুধু তাই নয়, তা একই সময়সীমার
মধ্যে সারা ভারতের বৃদ্ধির হার, এবং প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের বৃদ্ধির হারের
তুলনায়ও বেশি, যদিও কতটা বেশি সেটা কী ভাবে হিসেবে করা হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করছে।
৩
কৃষিতে
রাজ্যের সাফল্য উল্লেখের দাবি রাখে কিন্তু সমস্যা হল, উন্নয়নের ধ্রুপদী তত্ত্ব বলে বিভিন্ন দেশে, অঞ্চলে, ও কালে সময়ের সাথে সাথে কৃষির
গুরুত্ব কমে, শিল্পের গুরুত্ব বাড়ে, এবং পরিষেবার গুরুত্ব আরও বাড়তে থাকে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুধু কোন একটি ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধির মাধ্যমেই শুধু
হয়না, তার জন্যে প্রয়োজন মূল যে অর্থনৈতিক উপাদানগুলো - অর্থাৎ, শ্রম, পুঁজি, এবং
ভূমি - সেগুলো নতুন ধরণের প্রয়োজন মেটাতে নতুন ভাবে বিন্যস্ত হয়, অধিক থেকে অধিকতর
মূল্যের উৎপাদনে নিয়োগ করার নিরন্তর প্রক্রিয়ায়, যার গতি সচরাচর কৃষি থেকে শিল্প
এবং পরিষেবার দিকে। এ ভাবেই শহরাঞ্চলের প্রসার হয়ে থাকে। বর্তমান দুনিয়ার ধনী
দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে এই সব পর্ব উৎরে তবেই আজকের জায়গায় এসে পৌঁছেছে।
এই
দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলে রাজ্যের অর্থনৈতিক যাত্রাপথ অবশ্যই খানিক বিপরীতমুখী।
সাম্প্রতকিকালেও - যেমন, গত এক দশকে দেশের তুলনায় রাজ্যে কৃষিতে বৃদ্ধির হার দেশের
গড়ের থেকে বেশি থেকেছে, সার্বিক বৃদ্ধির হার কম হওয়া সত্ত্বেও। কিন্তু আয় এবং
কর্মসংস্থানের দিক থেকে দেখলে শিল্প ও পরিষেবাক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার না বাড়লে
সার্বিক বিচারে রাজ্যের অর্থনৈতিক পশ্চাদপসরণ অব্যাহত থাকবে।
রাজ্যের
অর্থনীতির সার্বিক অগ্রগতির পথে অনেক অন্তরায় তবে এর একটা বড়ো কাঠামোগত কারণ হল
শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্যের জন্যে জমির সমস্যা। বামফ্রণ্টের সীমিত ভূমিসংস্কার শুরু
হবার তিন দশক পরে সিঙ্গুরে রাজ্যে শিল্পায়নের পথে মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়ালো
জমি-অধিগ্রহণের সমস্যা।
সমস্যাটা
সারা দেশের জন্যে প্রযোজ্য হলেও জনসংখ্যার তুলনায় ভূমির অপ্রতুলতা এবং জনসংখ্যার
চাপের ফলে সময়ের সাথে সাথে ভূমির ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অংশে বিভাজিত হবার
প্রবণতা রাজ্যের ক্ষেত্রে আরও প্রকট। তার ওপর সীমিত ভূমিসংস্কারের ফলে ভূমিহীন
কৃষকদের হাতে জমি আসা এবং বর্গা আইনের কারণে অনেকক্ষেত্রে জমির মালিকদের
ভাগচাষীদের কাছে জমি বেচে দেওয়ার কারণে ক্ষুদ্র ও প্রার্ন্তিক কৃষকের সংখ্যা অনেক
বেড়ে গেছে। সাম্প্রতিক কৃষি সেন্সাস থেকে জানা যাচ্ছে যে রাজ্যের কৃষিতে নিয়োজিত
জমির গড় পরিমাপ সত্তরের দশকের গোড়ার তুলনায় ২০১৫-১৬ সালে কমেছে প্রায় ৪০%, এবং
দেশের বর্তমান গড়ের সাথে তুলনা করলে তা রাজ্যের তুলনায় দেড়গুণ বেশি। একইসাথে
কৃষিতে নিযুক্ত জমিতে প্রান্তিক চাষিদের (যাদের জমির আয়তন এক হেক্টর বা তার কম)
অনুপাত সত্তরের দশকের গোড়ায় ছিল ৬০%, যা ২০১৫-১৬ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩% - যেখানে
সারাদেশে বর্তমানে প্রান্তিক চাষিদের অনুপাত ৬৮%।
আরেকটা
সমস্যা হলো জমির বাজার ঠিক আর পাঁচটা বাজারের মতো নয় যে দাম বাড়লে যোগান বাড়বে এই
সরল যুক্তিটা খাটে। জমি শুধু রোজগারের উৎস নয়, জমির মালিকানা একটা বড় ধরনের আর্থিক
নিরাপত্তাও দেয়। ক্ষুদ্র জমির মালিকদের কাছে এই দ্বিতীয় কারণটি বিশেষভাবে
গুরুত্বপূর্ণ তাই জমির দাম বাড়লে তারা বরং বেশি করে জমি আঁকড়ে থাকতে পারেন, তাই
বাড়ার বদলে জমির যোগান কমেও যেতে পারে। ধনী চাষির হাতে উদ্বৃত্ত জমি আছে, তাই দাম
বাড়লে তাঁদের কাছে থেকে জমির যোগান বাড়বে কিন্তু সার্বিক যোগান নির্ভর জোড়বে জমির
বন্টনের ওপর। রাজ্যের সীমিত ভূমিসংস্কার এবং জমিতে
জনসংখ্যার চাপ এই দুই কারণের ফলে ক্ষুদ্র ও প্রার্ন্তিক কৃষকের সংখ্যা বেশি, তাই
দাম বাড়লে যোগান না বাড়ার সম্ভাবনা বেশি। আমাদের সমীক্ষা থেকে দেখছি যে পরিবারের
হাতে জমির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম, এবং যাদের কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা যত বেশি, তাঁরা জমি বেচতে ততই অনিচ্ছুক। এখানে রাজ্যের অর্থনীতিতে একটা
বিষচক্র কাজ করেছে - শিল্প হচ্ছেনা বলে বিকল্প কম আবার বিকল্প কম বলে জমির ওপর
নির্ভরতা প্রবল, আর তাই শিল্প হচ্ছেনা।
"কৃষি আমাদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ"
স্লোগানটি রাজ্যে কার্যকর হতে পারেনি। বরং এটাকে পাল্টে বলা যেতে পারে কৃষি একই
সাথে রাজ্য অর্থনীতির শক্তি এবং দুর্বলতা। আর এর একটি প্রধান কারণ হল, জমি নিয়ে
জটিলতা। অদৃষ্টের পরিহাস হল যে আগের জমানায় সীমিত ভূমিসংস্কারের সাফল্য এই
প্রবণতাকে আরও প্রকট করে দিয়েছে।
[এই লেখাটিতে আমার আগের দুটি লেখার কিছু অংশ অপরিবর্তিতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে: ঘটক (২০২২) এবং বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঘটক (২০০০)। আমার বাবা শ্রী মৈত্রেয় ঘটকের নিজস্ব গবেষণার একটি বিষয় ছিল পশ্চিমবঙ্গে ভূমি-সংস্কার এবং তাই এই বিষয়ে কিশোর বয়স থেকেই আমার উৎসাহের জন্যে তিনি দায়ী। শুধু তাই নয়, আমার এই বিষয়ে গবেষণা করার সময়ে সমীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব তিনি নেন। তাঁর মৃত্যু হয় ২০০৩ সালে। তাঁর কথা শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি। ]
No comments:
Post a Comment