নির্বাচনী প্রচারের জন্যে এবং দল চালানোর জন্যে অর্থের দরকার ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক
দলগুলো যেভাবে এই অর্থসংগ্রহ করে, তা নিয়ে সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশেই বিতর্ক আছে, ভারত
তার ব্যতিক্রম নয়। আশংকা হলো, যারা ধনী ও প্রভাবশালী তাদের অর্থবল “এক ব্যক্তি এক
ভোট” এই মৌলিক গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী।
ভারতের ক্ষেত্রে নির্বাচনী বন্ড বিষয়টি আবার এই বিতর্ক উসকে দিয়েছে। বিরোধীদের যুক্তিগুলি
প্রধানত দুটি বিষয় নিয়ে: প্রথমতঃ বন্ডের মাধ্যমে টাকা দেওয়ার কোন ঊর্ধধসীমা নেই এবং
দ্বিতীয়তঃ, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে টাকা দানকারীর পরিচয় গোপন থাকবে। অর্থাৎ, যে কোন
ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যেকোন অঙ্কের একটি বন্ড কিনে তাঁর পছন্দের পার্টিকে দিতে পারেন এবং
সেই পার্টি বন্ডটি ভাঙ্গিয়ে সেই টাকা নিজের তহবিলে ভরতে পারেন। সেই টাকা কোন শিল্পপতির
পকেট থেকে এল নাকি কোন লবিকারী সংস্থা না নিতান্তই একজন সাধারণ সমর্থকের পকেট
থেকে এল তা জানার কোন উপায় নির্বাচনী বন্ডের ক্ষেত্রে নেই। বন্ডের এই দুই বৈশিষ্ট্যের
সুযোগ নিয়ে বড় শিল্পপতিরা টাকা দেওয়ার বিনিময়ে সরকারের থেকে অন্যায় সুবিধা নিতে পারে
– মূলত এই অভিযোগ নিয়েই বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন এবং তারই
জেরে জাতীয় নির্বাচনের মাত্র মাস দুয়েক আগে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নির্বাচনী বন্ড
অসাংবিধানিক ঘোষিত হয় এবং ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ বন্ডের দাতা এবং গ্রহীতাদের পূর্ণ
তালিকা প্রকাশ করে।
এই তালিকা জনপরিসরে প্রকাশিত হওয়ার পরে সংবাদ ও সমাজ মাধ্যমে নির্বাচনী বণ্ড সংক্রান্ত
একাধিক তথ্য উঠে আসে যা নির্বাচনী বন্ডের অপব্যবহার সংক্রান্ত প্রাথমিক আশঙ্কাকেই মান্যতা
দেয়। দেখা যায় এমন অনেক কোম্পানী বন্ডের মাধ্যমে টাকা দিয়েছে যারা তাদের ব্যালেন্স শিটে
আর্থিক ক্ষতি দেখিয়েছে। আবার অনেক কোম্পানির ক্ষেত্রে তাদের বন্ড অনুদানের পরিমাণ তাদের
লাভের অঙ্কের চেয়ে বেশী। এটাও দেখা যায় অনেক কোম্পানি টাকা দিয়েছে দরজায় সিবিআই-
ইডি কড়া নাড়ার পরে। এই সব টুকরো টুকরো তথ্য থেকে জনমানসে এরকম একটা ধারণাই
আরও বদ্ধমূল হয় যে নির্বাচনী বন্ড ধনীদের অর্থের বিনিময়ে বেআইনি সরকারি সুবিধা আদায়
করার একটা ব্যবস্থা মাত্র, যার ফলে সরকারি নীতি জনহিতের পরিবর্তে কোম্পানির মুনাফা
বৃদ্ধিতে মনোযোগী হয়ে পড়তে বাধ্য।
আমরা দুটি বিষয় একটু তলিয়ে দেখব: প্রথমত, বন্ডের মাধ্যমে কারা টাকা পাচ্ছে এবং বন্ডে
পাওয়া টাকা কি এত বেশী যে তা অন্য অনুদানকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিচ্ছে; দ্বিতীয়ত, কেন্দ্র বা
রাজ্য কোথাও ক্ষমতায় থাকা পার্টি কী বন্ডের মাধ্যমে বাড়তি সুবিধা পেয়েছে? এক্ষেত্রে আমাদের
প্রাক-অনুমানটি হল যারা ক্ষমতায় আছে তাদের টাকার বিনিময়ে সুবিধা দেওয়ার ক্ষমতা বেশী।
তাই শুধুমাত্র তারা যদি টাকা পায়, তাহলে টাকার বিনিময়ে সুবিধা প্রদানের তত্ত্বটি আরেকটু
মান্যতা পাবে।
আমরা মূলত দুটি জায়গা থেকে আমাদের তথ্য সংগ্রহ করেছি। তার মধ্যে একটি ভারতীয় স্টেট
ব্যাঙ্ক কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য যাতে ২০২৪ এর জানুয়ারি পর্যন্ত সমস্ত বন্ডের তথ্য আছে। অন্যটি
হল, অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর) প্রকাশিত একটি রিপোর্ট যাতে
২০১৬-১৭ থেকে ২০২১-২২ এর মধ্যে কোন পার্টি বন্ড এবং অন্য অনুদান কত পেয়েছে তার
একটি হিসেব। এই রিপোর্টটি প্রস্তুত হয়েছে বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক পার্টি কর্তৃক প্রকাশিত
অনুদান রিপোর্ট যা নির্বাচনী কমিশনকে প্রতি বছর পেশ করতে হয় তার ওপর ভিত্তি করে।
দুটি তথ্যসুত্রের সময়কাল এবং তথ্যের লভ্যতায় সামান্য পার্থক্য রয়েছে, তবে দুটি সূত্র থেকে মুল
যে কথাটি বেরিয়ে আসছে তার মধ্যে গুণগত ফারাক খুব বেশি নেই।
একে একে এই দুটি প্রশ্নের উত্তরগুলি দেখা যাক। এডিআর রিপোর্ট থেকে পাওয়া যাচ্ছে যে,
২০১৬-১৭ থেকে ২০২১-২২ এর মধ্যে মোট যে টাকা রাজনৈতিক দলগুলি পেয়েছে তার প্রায়
৫৬% এসেছে নির্বাচনী বন্ড থেকে, প্রায় ২৮% এসেছে কর্পোরেট অনুদান থেকে (যার মধ্যে
নির্বাচনী ট্রাস্টও আছে) আর অন্যান্য সূত্র (ব্যক্তিগত দান, সদস্যদের চাঁদা, মিটিং-মোর্চা
থেকে সংগ্রহ ইত্যাদি) থেকে এসেছে প্রায় ১৬%। খেয়াল রাখতে হবে যে স্টেট ব্যাঙ্ক তালিকায়
প্রথম বন্ডের তথ্য নথিভুক্ত আছে ২০১৯ থেকে। সুতরাং আমরা যদি অনুদান রিপোর্টের পরবর্তী
সংস্করণগুলির হিসেব নিতে পারি তাহলে তাহলে বন্ডের অনুপাত নিঃসন্দেহে বাড়বে। কিন্তু বন্ড
কী অ-বন্ড অনুদানকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিচ্ছে? এই প্রশ্নের কোন সহজ উত্তর নেই। বিজেপির
জন্য বন্ড বা অ-বন্ড – দুরকম অনুদানের পরিমাণই অনেক বেশি। ২০১৬-১৭ থেকে ২০২১-২২
এর মধ্যে একা বিজেপি বন্ডের মাধ্যমে পেয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি, যেখানে
দেশের অন্য সব পার্টি মিলে পেয়েছে প্রায় তিন হাজার নশ’ কোটি টাকা, অর্থাৎ বিজেপির
সংগ্রহে এসেছে প্রায় ৫৭ শতাংশ। বিজেপির এই আধিপত্য কিন্তু অ-বন্ড অনুদানেও একই ভাবে
প্রযোজ্য – চার হাজার আটশ’ পঞ্চাশ কোটি টাকা, অন্য সব পার্টি মিলে পেয়েছে প্রায় দু-হাজার
তিনশ আটানব্বই কোটি টাকা, অর্থাৎ বিজেপির সংগ্রহে এসেছে প্রায় ৬৬ শতাংশ, তার মধ্যে
কর্পোরেট অনুদানের অবদান ৭১%।
এর থেকে যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি টাকা নিঃসন্দেহে
বিজেপির কাছে গেছে। এর ফলে বিজেপির আর্থিক ক্ষমতা যেখানে পৌঁছল তার মোকাবিলা করা
খুব সহজ কথা নয়। যদিও একথা ঠিক যে বন্ডের সব টাকা বিজেপি পায় নি, বন্ডের অর্ধেকের
কাছাকাছি টাকা অ-বিজেপি পার্টিদের কাছেও পৌঁছেছে।
এখান থেকে আমরা পরের প্রসঙ্গে আসব। আমরা দেখব বিজেপি বাদে আর কোন কোন পার্টি
বন্ড থেকে টাকা পেয়েছে এবং কোন কোন পার্টির বন্ড নির্ভরতা বেশি। এই দুটি উত্তরের সঙ্গে
অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের অন্য মূল প্রশ্নের উত্তর – বন্ডের টাকা কী শুধু ক্ষমতাসীন
পার্টির কাছে যায়?
কমিউনিস্ট পার্টিগুলি ঘোষণা করেছিল তারা বন্ডের মাধ্যমে টাকা নেবে না। বাকি অ-বিজেপি
জাতীয় এবং আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে বেশি টাকা এসেছে জাতীয় কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস,
বিজু জনতা দল, ডিএমকে, ভারত রাষ্ট্র সমিতি, তেলেগু দেশম পার্টি এবং ওয়াই এস আর
কংগ্রেস। এছাড়া শিবসেনাও বন্ডের মাধ্যমে বড় অঙ্কের অনুদান পেয়েছে। আমরা যদি বিভিন্ন
পার্টির তাদের মোট অনুদানের কত শতাংশ টাকা বন্ডের মাধ্যমে আসছে সেটা দেখি তাহলে
দেখব এই তালিকার শীর্ষে আছে তৃণমূল কংগ্রেস (৯৩%)। তারপর ক্রমাণ্বয়ে রয়েছে ডিএমকে
(৯০%), বিজেডি (৯০%), ভারত রাষ্ট্র সমিতি (৮০%), ওয়াই এস আর কংগ্রেস (৭২%)
এবং তেলেগু দেশম পার্টি (৬৭%)। বিজেপি এবং কংগ্রেস এর জন্য এই অনুপাত যথাক্রমে ৫২%
এবং ৬১%।
কিন্তু যারা পেল তারা কী ক্ষমতাসীন পার্টি বলেই পেল? এই প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ – ওপরের
তালিকার অনেক পার্টিই ক্ষমতাসীন। কিন্তু তার মধ্যেও বৈচিত্র রয়েছে। যেমন ধরা যাক
ডিএমকের কথা। স্টেট ব্যাঙ্কের তথ্য রয়েছে ২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে একটা
বড় সময় ডিএমকে ক্ষমতায় ছিল না। ক্ষমতায় না থাকার সময় ডিএমকে পেয়েছে প্রায় একশ
অষ্টাশি কোটি টাকা যেখানে ক্ষমতায় গিয়ে তারা পেয়েছে প্রায় চারশ চুয়াল্লিশ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ডিএমকে যখন ক্ষমতায় ছিল না তখন ছিল এআইডিএমকে। কিন্তু তারা বন্ড থেকে
পেয়েছে মাত্র ছ-কোটি টাকা। একই ভাবে ক্ষমতায় না থেকেও বন্ড থেকে ভাল পরিমাণ টাকা
পেয়েছে তেলেগু দেশম পার্টি (সারা দেশের মোট বন্ড অনুদানের ১.৭৪%) যেখানে একই রাজ্যে
ক্ষমতায় থাকা ওয়াই এস আর কংগ্রেস পেয়েছে সারা দেশের মোট বন্ড অনুদানের প্রায় ২.৭%।
ক্ষমতায় থেকেও খুব কম টাকা বন্ড অনুদানের মাধ্যমে পেয়েছে দুটি পার্টি – আপ এবং ঝাড়খন্ড
মুক্তি মোর্চা।
তাহলে মোদ্দা কী বোঝা গেল? বন্ডের টাকার সুবিধে বিজেপি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি, কিন্তু অ-
বিজেপি পার্টিগুলির কাছে বন্ডের যে টাকা গেছে তার সুবিধা পেয়েছে কয়েকটা মাত্র পার্টিই ।
এর ফলে আর্থিক সামর্থ্যের বিচারে ভারতীয় রাজনীতিতে একটি অভূতপূর্ব অসাম্য তৈরি হয়েছে।
অর্থনির্ভর রাজনীতির এই যুগে এই অসাম্য এক বিপজ্জনক সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করে । এর
ফলে নির্বাচনে অর্থপূর্ণ ভাবে প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারে এরকম পার্টির সংখ্যা ধীরে, ধীরে কমে
আসবে, কমে আসবে রাজনৈতিক মতামতের বিভিন্নতা এবং একজন ভোটারের সামনে বেছে
নেওয়ার সুযোগ সঙ্কুচিত হবে। আমরা ভারতে ইদানিংকালে যেমন দেখছি অর্থনীতির ক্ষমতা
কেন্দ্রীভূত হয়ে রয়েছে কয়েকটি সংস্থার হাতে, ঠিক তেমনই নির্বাচনী বন্ডের ফলে রাজনৈতিক
ক্ষমতা কেন্দ্রীভুত হতে পারে কয়েকটি পার্টির হাতে। অন্যদিকে, বন্ডের টাকা থেকে বঞ্চিত
পার্টিরা লড়াইতে টিকে থাকার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নেবে। খেয়াল করে দেখুন যে তিনটি দল
ক্ষমতায় থেকেও বন্ডের মাধ্যমে টাকা পায়নি তাদের মধ্যে দুটি দলের মুখ্যমন্ত্রীরা ক্ষমতাসীন
অবস্থাতেও দুর্নীতির দায়ে জেলে গেছেন আর অন্য দলটি ক্ষমতায় ছিল বিজেপির সঙ্গে হাত
মিলিয়ে। আমাদের মতে নির্বাচনী বন্ড প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বড় বিপদ এটাই।