Saturday, January 7, 2023

নামে কী আসে যায়?

ঝুম্পা লাহিড়ী, ‘নেমসেক’, হার্পার-কলিন্স।  

আনন্দবাজার পত্রিকা, পুস্তক সমালোচনা, অক্টোবর ৭, ২০০৩।  

অ্যামেরিকার গড়পরতা জনপ্রিয় “পারিবারিক” উপন্যাসগুলোর শুরুর দৃশ্যটা অনেক সময় এই রকম হয় - ছুটির দিন, বস্টন এর কোনো শহরতলীর বাড়ির জানলার কাঁচে রক্তিমাভ মেপল গাছের পাতার পরশ, বাতাসে হেমন্তের আমেজ, গৃহিনী রান্নায় ব্যস্ত, সন্ধ্যেবেলা অতিথি আপ্যায়ন হবে, এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাত…অর্থাৎ, এইবার নাটকীয় কোনো ঘটনা ঘটবে, নয়তো তার খবর আসবে টেলিফোনে। 

রান্নার পদ রোস্টেড চিকেন পাল্টে করে দিন চিঙড়ির মালাইকারি, চরিত্রদের নাম বারবারা-জন পাল্টে করে দিন নন্দিনী-অমিতাভ, আর ঘটনার জায়গায় মধ্যবয়স্ক জনের পরকিয়া প্রেমের গোপনবৃত্তান্ত সহসা উদ্ঘাটন, বা আরো আধুনিক হতে চাইলে অপারেশন করে জেনি নাম্নী নারী হবার অঙ্গীকার ঘোষণা পাল্টে করে দিন নন্দিনী-অমিতাভের কন্যা শর্মিলার সহসা বিদ্রোহঘোষণা যে সে মা-বাবার পছন্দসই প্রবাসী বাঙালি পাত্রের সাথে বিয়ের সম্ভাবনায় রাজি নয় মোটেই, হৃদয় সঁপেছে সে কানে দুল পরা লম্বা চুল ঢুলুঢুলু চোখের এক বাউন্ডুলে অ্যামেরিকান ছেলের কাছে। 

নাম-পরিচয় পাল্টে দিলেও বইটি কি ও দেশে একইরকম জনপ্রিয় হতো? প্রবাসী বাঙালিদের বাদ দিলে সাধারণ   অ্যামেরিকান পাঠকরা কি সাগ্রহে পড়তেন এই কাহিনী ? এই অদ্ভুত চিন্তাটি মাথায় এলো ঝুম্পা লাহিড়ী-র অ্যামেরিকার পটভূমিকায় একটি প্রবাসী পরিবারকে কেন্দ্র করে লেখা বহু প্রতীক্ষিত নতুন উপন্যাস ‘দ্য নেমসেক’ পড়তে পড়তে।  

ঝুম্পা বয়েসে নবীন, কিন্তু এর মধ্যেই ইংরেজি ভাষায় যে ভারতীয় বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখকেরা দেশে-বিদেশে নাম করেছেন তাঁদের সাথে এক নিঃশাসে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। ঝুম্পার প্রথম বই ছোট গল্পের সংকলন ‘ইন্টারপ্রেটার অফ ম্যালাডিস’ প্রকাশ হবার পরে মার্কিন দেশে বেশ সাড়া ফেলেছিল, পুলিটজার প্রাইজ পেয়েছিল। তাঁর এই দ্বিতীয় বইটি হলো  আদি-নিবাস কলকাতা, অধুনা বস্টন-বাসী গাঙ্গুলী পরিবারের তিন দশক আর দুই প্রজন্মের আখ্যান।  

পূর্ববর্ণিত কাল্পনিক উপন্যাসটি যে গোত্রের সাহিত্যের নমুনা, তার সাথে সাহিত্যিক গুণমানের দিক থেকে ঝুম্পার লেখার কোনো তুলনা হয়না। তাঁর ভাষা নির্মেদ, স্থান-কাল-ঘটনার বর্ণনা সুদক্ষ শিল্পীর মতো যত্নশীল এবং মানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিবরণ মর্মস্পর্শী। কিন্তু পূর্বে উত্থাপিত প্রশ্নটি-র মতো একই ধরনের একটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে থাকে আলোচ্য  উপন্যাসটি পড়েও – ঘটনাবলী এক রেখে বা কিঞ্চিৎ অদলবদল করে চরিত্রগুলো যদি অ্যামেরিকায় প্রবাসী বাঙালি না হয়ে অ্যামেরিকায় প্রবাসী ইতালীয় বা আইরিশ হতো, তাহলে কেমন লাগতো বইটি? নামে কি সত্যি কিছু আসে যায়? উপন্যাসটির মধ্য দিয়ে দিয়ে বাঙালি জীবনের যে ছবি ফুটে ওঠে, তার প্রতি প্রাচ্য সম্পর্কে স্বল্পপরিচয়প্রসূত রোমান্স-জড়ানো কৌতুহলই কি টানে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদে নব্যদীক্ষিত পাশ্চাত্যের পাঠককে? না কি যে কোনো দেশের যে কোনো  কালের পাঠককেই আকৃষ্ট করবে অভিবাসীদের ফেলে আসা জীবনের প্রতি পিছুটান, আর নতুন অপরিচিত পৃথিবীতে সাফল্যের ও স্বচ্ছলতার অমোঘ আকর্ষণের টানাপোড়েনের চিরন্তন মানবিক এই কাহিনী?

গল্পের শুরু হচ্ছে কেন্দ্রীয় চরিত্র গোগোলের বস্টন শহরে জন্ম দিয়ে। তার বাবা অশোক এমআইটি-তে ইঞ্জিনিয়ারিংএ পিএইচডি করছেন, মা অসীমা গৃহবধু। দুজনেই বড়ো হয়ে উঠেছেন কলকাতায়। সন্তানের ডাকনাম দেওয়া হলো গোগোল। নিকোলাই গোগোল শুধু যে অশোকের অন্যতম প্রিয় লেখক তা শুধু নন, যৌবনে এক ভয়াবাহ ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান যাত্রাপথে রাত জেগে এই লেখকের ছোট গল্পের সংকলন পড়ছিলেন বলে। অসীমার দিদার দেশ থেকে ভালো নাম পছন্দ করে পাঠানোর কথা চিঠিতে, সে চিঠি আর আসেনা, পরে জানা যায় পক্ষাঘাতে তিনি বোধশক্তি হারিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত একটা ভালো নাম বাছা হয় বটে, নিখিল, যা একটি পরিচিত বাঙালি নাম আবার নিকোলাইয়ের সাথে মিলও আছে, কিন্তু ঘটনাচক্রে গোগোল নামেই সে পরিচিত হয় ঘরেবাইরে। 

বড় হয়ে উঠতে উঠতে তার নাম নিয়ে গোগোলের মনে চলে নিরন্তর টানাপোড়েন। গোগোল নামটি তার ভাল লাগেনা – একে অদ্ভুত নাম, তায় সেটা না অ্যামেরিকান না ভারতীয়, তাই সব জায়গায় পরিচয় দেওয়ার সময় শুরু হয়ে যায় নাম নিয়ে এক অবধারিত কথোপকথন। বিদেশে বড় হয় ওঠা, স্কুলের আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের থেকে আলাদা হবার অস্বস্তি ও নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা কেন্দ্রীভূত হয় তার নিজের নামটির প্রতি বিতৃষ্ণায়। সাবালক হয়ে সে আদালতে দরখাস্ত করে গোগোল নামটি বিসর্জন দেয়, বাইরের পৃথিবীতে পরিচিত হয় শুধুমাত্র নিখিল বলে। তার মা-বাবা এবং আত্মীয়-বন্ধুরা অবশ্য তাকে  গোগোল নামেই ডাকতে থাকে।  এই পিছুটান তাকে অস্বস্তিতে রাখে। যেমন অস্বস্তিতে রাখে তার মা-বাবার সমস্ত সামাজিক জীবন স্থানীয় বাঙালি সমাজকে নিয়ে আবর্তিত হওয়ায়, যার সাথে সে তার বাইরের পৃথিবীকে মেলাতে পারেনা। তাঁদের মন যেন পড়ে আছে ফেলে আসা আলোকবর্ষ দূর এক গ্রহে, যা কয়েক বছর অন্তর কলকাতার অগণিত আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতে যাবার ঝটিকা সফর বাদ দিলে গোগোলের কাছে অপরিচয়ের আঁধারে ঢাকা।

ঝুম্পা এই পরিবেশ, এই জীবনের কথা তাঁর নিজের অ্যামেরিকায় প্রবাসী বাঙালি পরিবারে বড় হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা থেকে খুবই অন্তরঙ্গ ভাবে জানেন। সহজ গদ্যে প্রবাসী জীবনের নেহাতই সাধারণ দৈনন্দিন নানা ঘটনার মধ্যে তিনি সহসা পাঠককে কিছু চিরন্তন জীবনজিজ্ঞাসার মুখোমুখি করে দেন। বইটি পড়তে পড়তে মূল চরিত্রগুলি, অর্থাৎ গোগোল আর তার মা-বাবা, হয়ে ওঠে আমাদের কাছের মানুষ। অন্যান্য চরিত্রগুলি অবশ্য মনে অতটা রেখাপাত করেনা। যেমন গোগোলের জীবনে যে বান্ধবীরা আসে এবং বিদায় নেয় অকস্মাৎ, বাহ্যিক তফাৎ সত্ত্বেও চরিত্র হিসেবে যেন একইরকম মনে হয়, কিছুটা খামখেয়ালি ও আত্মকেন্দ্রিক। এ ছাড়া উপন্যাসটি প্রায় সম্পূর্ণভাবে হাস্য-কৌতুক-পরিহাস বর্জিত, যা চরিত্রগুলির জীবনের সংকীর্ণ গন্ডী আর আবহে বিষাদের সুরের সাথে মিলেমিশে মাঝেমাঝে বন্ধ ঘরে আবদ্ধ থাকার অনুভূতি জাগাতে পারে পাঠকের মন।    

তুলানামূলক বিচার করতে গেলে যে উপন্যাসটির নাম প্রথমে মনে হয় তা হলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব পশ্চিম’। এতে প্রবাসী বাঙালি জীবনের টানাপোড়েনের যে ছবি পেয়েছি তা মনে দাগ কেটেছিল অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, চার দেশ অর্ধশতক ব্যাপী এই কাহিনীতে অগণিত চরিত্রের জীবনস্রোতের আপাতবিচ্ছিন্ন ধারা ক্রমে মিলেমিশে প্রবল কলরোলে পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মোহনার দিকে, যেখানে নাম-পরিচয় অবান্তর মনে হয়। এই উপন্যাসটি বাংলা পাঠকদের কাছে আর পাঁচটা মনোরঞ্জক লেখার সাথে মিলেমিশে তার প্রাপ্য গুরুত্ব পায়নি বলে মনে হয়। আর ইংরেজি ভাষার দেশি বা বিদেশি পাঠকদের কতজনই বা জানেন এটির কথা। কিছু সমসাময়িক বাংলা লেখার অনুবাদ হলেও, দেশে-বিদেশে তাদের প্রচার খুবই সীমিত। তা না হলে আর সালমান রুশদি কি করে বলতে পারেন যে ভারতীয় সাহিত্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ইংরেজি ভাষায়, আঞ্চলিক ভাষায় নয়।

আর বাংলা ছেড়ে আন্তর্জাতিক সাহিত্যের দিকে যেদি তাকাই, ইংরেজি ভাষায় লেখা অভিবাসী জীবন নিয়ে সম্প্রতি পড়া  কোন উপন্যাসটি সবচেয়ে ভাল লেগেছে যদি জিজ্ঞেস করেন, তার উত্তরে যে বর্ণোজ্জ্বল উপন্যাসটির কথা বলব, ইংল্যান্ডে বড় হয়ে ওঠা ইংরেজ বাবা এবং জামাইকান মায়ের কন্যা জেডি স্মিথের একটি প্রবাসী বাংলাদেশী পরিবার আর একটি জামাইকান-ইংরেজ মিশ্র পরিবারের দুই প্রজন্মকে নিয়ে লেখা ‘হোয়াইট টিথ’।

[পুরনো ফোল্ডারে একটা কাজের ফাইল খুঁজতে গিয়ে চোখে পড়ল অনেকদিন আগে আমার লেখা প্রথম (ও হয়তো)

শেষ উপন্যাস সমালোচনার কথা, আনন্দবাজার পত্রিকায় বেরিয়েছিল ২০০৩ সালের অক্টোবরের গোড়ার দিকে। 

আনন্দবাজারের পুরনো সংস্করণের পাতায় ফন্টের সমস্যা - তাই লিংক থাকলেও ফন্টের সমস্যার জন্যে পড়া যায়না:

https://archives.anandabazar.com/archive/1031007/4pustak1.htm]

No comments:

Post a Comment